রবিবার, ২৯ মে, ২০১৬

হিকমাহ বনাম সুবিধাবাদ

কোন মন্তব্য নেই:

***************************
হিকমাহ বনাম সুবিধাবাদ*****************
.
আল কুরআনে হা-কাফ-মিম (হিকমাহ/হাকীম/হুকুম ইত্যাদি কখনও বা কর্মবাচ্য ও ক্রিয়া হিসেবে অপর কোন হরফের সাথে সংযুক্ত করে) শব্দটির বিভিন্ন রূপ বিভিন্ন সময়ে এসেছে। অধিকাংশ সময়ই আল্লাহকে হাকীম বা ‘শ্রেষ্ঠতম বিজ্ঞ’ অথবা একই শব্দের অন্য অর্থ ‘শ্রেষ্ঠতম বিচারক’ এই দুই ক্ষেত্রে এসেছে। সেই হিসাবে এই লফয থেকে দুটি উদ্দেশ্য একই সাথে প্রকাশ পায়- প্রথমত প্রজ্ঞা যা ইলম বা মা’লুমিয়্যাত থেকে ভিন্ন। দ্বিতীয়ত বিচার ফায়সালা বা হুকুম। এখানে ইনশাআল্লাহ প্রথম ক্ষেত্রটি নিয়েই প্রধান আলোচনা করবো। দ্বিতীয় বিষয়টির ব্যাপারে জানতে পড়ুন আল মায়েদার ৪৩-৪৮, আল আম্বিয়ার ৭৮, আর রা’দ এর ৪১ ইত্যাদি আয়াতসমূহ।
.
মানুষের উপর চব্বিশ ঘন্টা সালাত ফরয থাকে না বা সারা বছর রোযাও না, জীবনে শুধু একবারই হজ্জ্ব ফরয থাকে, বছরে একবার যাকাত দিয়ে দিলেই তার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। কিন্ত ধৈর্য্য, হিকমাহ, তাক্বওয়া এগুলো এমন কিছু ইবাদাত যা একজন মুমিনকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সবসময় পালন করতে হয়। এজন্যে হিকমাহর গুরুত্ব মুসলিমের জীবনে অপরিসীম, হিকমাহ সম্বন্ধে সঠিক দ্বীনী বুঝ লাভ করাও এজন্যে অত্যন্ত জরুরী।
.
আল্লাহ তাআলা বান্দাদের মাঝে নিজের গুনের কিছু প্রতিফলন ঘটান। দয়া, ক্ষমা, ভালবাসা- তেমনি প্রজ্ঞাও এমন একটি সিফত। আল্লাহ বলেন, “তিনি যাকে ইচ্ছা বিশেষ জ্ঞান দান করেন এবং যাকে বিশেষ জ্ঞান দান করা হয়, সে প্রভুত কল্যাণকর বস্তু প্রাপ্ত হয়। উপদেশ তারাই গ্রহণ করে, যারা জ্ঞানবান।” (২: ২৬৯)
.
ইবরাহীম(আ) নিজ বংশধরদের জন্যে আল্লাহর কাছে দুয়া করেছিলেন, “হে পরওয়ারদেগার! তাদের মধ্যে থেকেই তাদের নিকট একজন পয়গম্বর প্রেরণ করুণ যিনি তাদের কাছে তোমার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করবেন, তাদেরকে কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দিবেন। এবং তাদের পবিত্র করবেন। নিশ্চয় তুমিই পরাক্রমশালী হেকমতওয়ালা।” (২: ১২৯)
.
আবার স্বয়ং আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার এক ইউনিভার্সাল পদ্ধতিও শিখিয়ে দিয়েছেন, “আপন পালনকর্তার পথের প্রতি আহবান করুন জ্ঞানের কথা বুঝিয়ে ও উপদেশ শুনিয়ে উত্তমরূপে এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন পছন্দ যুক্ত পন্থায়। নিশ্চয় আপনার পালনকর্তাই ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে বিশেষ ভাবে জ্ঞাত রয়েছেন, যে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে।” (১৬: ১২৫)
.
এই আয়াতটির অন্যতম প্রতিফলন দেখা যায় রসূল(স) এর সাহাবীগনীর মধ্যে যারা ছিলেন “আশিদ্দা আলাল কুফফার” বা কুফফারদের প্রতি কঠোর এবং একই সাথে ‘রুহামা বাইনাহুম’ বা একে অপরের প্রতি মহব্বতওয়ালা যা সূরা ফাতহের আয়াত থেকে প্রমানিত হয়। সেই হিসাবে উক্ত তাদের চরিত্রের হিকমাহ ও ই’তিদালের ক্ষেত্রে কঠোরতাই আগে প্রাধান্য পেয়েছে।
.
আবার স্বয়ং রসূল(স) কে আল্লাহ দাওয়াতের ব্যাপারে মিষ্টভাষী ও কঠোরতা পরিহারকারী করে বানিয়েছিলেন। আবার মুসা(আ) কে ফিরআউনের নিকট প্রথম অবস্থায় নম্র ভাষায় দাওয়াত দেয়ার হুকুম ছিল। ঠিক তেমনি ভাবেই কাফেরদের প্রতি সাহাবাদের কঠোরতা, সময়ে সময়ে বিভিন্ন গোত্রে রাসূলের(স) দাওয়াতের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহন বা ফিরআউনের বাহিনীর বিরুদ্ধে মুসা(আ) বৈরিতা এবং মোক্ষম মুহুর্তে ইবরাহীম(আ) কর্তৃক স্বীয় সম্প্রদায়ের প্রতি বারাআত ঘোষনাও ছিল হিকমাহরই প্রয়োগ।
.
এছাড়াও আরো অনেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা হিকমাহর কথা উল্লেখ করেছেন যার প্রকৃত আমল আমাদের সমাজে যে শুধু দুর্লভ তা-ই না, বরং এর অপব্যাখ্যাটাই মানুষের মাঝে মুখরোচক এক কথায় পরিনত হয়েছে। বিশেষ করে দ্বীন সঙ্ক্রান্ত কোন ত্যাগ বা কুরবানির প্রশ্ন আসলেই হিকমাহর আড়ালে নিজের ব্যর্থতা লুকানোর প্র্যাক্টিস তো খুবই সাধারন। আমাদের যেহেতু সুযোগ নেই কুরআন বা হাদিস থেকে সালাফের মতের বাইরে কোন ধরনের বুঝ বা ব্যখ্যা নেয়ার, তাই সকল বিষয়ের মত হিকমাহ সঙ্ক্রান্ত ক্ষেত্রেও ঐদিকেই প্রত্যাবর্তন করতে হবে।
.
বুখারির এক হাদিস মতে আল্লাহর রসূল(স) ইমাম ইবনু আব্বাসকে(রা) একবার আলিংগন করে আল্লাহর কাছে দুয়া করেন যে আল্লাহ একে হিকমাহ দান কর। সেই দুয়ার বরকতে আল্লাহ তাআলা ইবনু আব্বাসকে তাফসীরের সর্বোচ্চ জ্ঞান দান করেন। অর্থাৎ এই দৃষ্টি থেকে হিকমাহ হল কিতাবের সুগভীর প্রায়োগিক জ্ঞান।
.
ইমাম ইবনু জারীর(রহ) এর মতে সুরা নাহলে হিকমাহর দ্বারা উদ্দেশ্য কালামুল্লাহ ও হাদীসে রসূল(স) আর সদুপদেশ দ্বারা ভয় ও ধমক মিশ্রিত ভাষণ উদ্দেশ্য। একই সাথে নম্রতা ও যৌক্তিকতার প্রতিও তিনি আলোকপাত করেছেন। ইমামের এই মতটির পূর্ন প্রতিফলন ঘটেছে স্বয়ং কিতাবুল্লাহতেই যখন আল্লাহ তাআলা ঠিক পরের আয়াতেই বলে দিয়েছেন, “যদি তোমরা প্রতিশোধ গ্রহণ কর, তবে ঐ পরিমাণ প্রতিশোধ গ্রহণ করবে, যে পরিমাণ তোমাদেরকে কষ্ট দেয়া হয়। যদি সবর কর, তবে তা সবরকারীদের জন্যে উত্তম।” অর্থাৎ নম্রতা বা কঠোরতা দুটোর কোনটাই হিকমাহর পরিপন্থী বিষয় নয় বরং নির্দিষ্ট স্থান-কাল-পাত্রে দুটোই হিকমাহ।
.
ইমাম ইবনিল কাইয়্যিম(রহ) তাঁর বিখ্যাত কিতাব মাদারিজুস সালিকিনে হিকমাহর তিনটি স্তরের কথা উল্লেখ করেছেন, “১. যেকোন আমলকে তার পূর্ন হক্ব অনুযায়ী আদায় করা, তা আদায় করতে দেরী না করা বা নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই তা করে না ফেলা। ২. আল্লাহর ওয়াদা থেকে তার ক্বদরের উপর ভরসা রাখা, তার ফায়সালা থেকে তার ইনসাফের ধারনা নেয়া এবং কোন ব্যাপারে নিজের সফলতা-ব্যার্থতা থেকে আল্লাহর মহিমার বুঝ নেয়া। ৩. কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পর্যায়ের তাহকীক ও বিশ্লেষন করা যেন অন্তর্চক্ষু ঐভাবে উদ্ভাসিত হয় যেভাবে চর্মচক্ষু দেখতে পায়। আর এটিই হিকমাহর সর্বোচ্চ চূড়া যেখানে সাহাবাগন অবস্থান করেন এবং কোন আলেমের ইলমের সর্বশেষ মাকাম এটিই।”
.
অর্থাৎ ফিকহী দৃষ্টিকোন থেকে কোন ইবাদাত তার সুনির্দিষ্ট সময়ের সাথে সাথে আদায় করে নেয়া। যেমন আউয়াল ওয়াক্তে নামাজ পড়ে নেয়া, রামাদান এলেই পরিপূর্ন ভাবে রোযা রাখা এবং ফারদুল আইন হলেই সম্মিলিত ভাবে জিহাদ করা ইত্যাদি। একই সাথে কোন ঘটনার দ্বীনী হুকুমের উপরে দুনিয়াবি প্রেক্ষাপট বা ফলাফলগত পরিনতিকে প্রাধান্য না দেয়া, আল্লাহর সিফতগুলোর উপর ভরসা করে তাঁর নির্দেশ বিনা দ্বিধায় পালন করতে থাকা। এভাবে আমলের মাধ্যমে এক পর্যায়ে কোন আলেম সর্বোচ্চ ইলমি স্তরে পৌছে যান। তিনি তার তাফসীরে আরো বলেন, “সত্যের ইলম, সত্যের উপর আমল করা এবং নিজের কথা ও কর্মকে সত্যে রূপান্তর করাই হিকমাহ।” অর্থাৎ কোন ধরনের পরিস্থিতিতেই নিজের অংগ প্রত্যগ, জবান বা অন্তর থেকে সত্যের ব্যাপারে আপোষ না করা।
.
মাদারিজুস সালিকীনের অন্যত্র তিনি বলেন, “হিকমাহ হল কখন কোথায় কোন কাজটা কিভাবে যথার্থ রূপে করতে হবে তার বুঝ।” অর্থাৎ একদম সময়মত আল্লাহ ও বান্দার হক্ব গুলো আদায় করে দেয়া, কোন ধরনের অলসতা বা অতি উৎসাহী মনোভাব না দেখানো, কোন ধরনের ইফরাত বা তাফরীত না করা, যুলম পরিত্যাগ করে আদল ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা এবং ই’তিদাল স্থাপনে খুবই সতর্ক হওয়া।
.
একই কিতাবে তিনি হিকমাহর দুটি স্তর বর্ননা করে বলেন, “প্রথম স্তর ইলমের সাথে জড়িত; নসের যথাযথ বুঝ, ফিকহ ও হুকুমাত এবং যাবতীয় ঘটনাবলির হাকীকত আত্মস্থ করা। দ্বিতীয় স্তর ওই ইলমকে কর্মে পরিনত করার সাথে জড়িত।” অর্থাৎ দ্বীনী ইলম শিখে তাকে বাস্তবায়ন করার জন্যে যা যা করার প্রয়োজন তার সবই আঞ্জাম দেয়া।
.
বিখ্যাত মুফাসসির আব্দুর রহমান আস সা’দী তার কিতাব তাইসীর আল কারিম আর রাহমান এ বলেন, “হিকমাহ গঠিত হয় উপকারী জ্ঞান, ঘটনাবলীর মা’লুমিয়াত, দৃঢ় যুক্তি, কঠোর সঙ্কল্প এবং কাজে-কর্মে নির্ভুল হওয়ার মাধ্যমে। হিকমাহর মাধ্যমেই কোন আমল কে যথাস্থানে বসানো যায় যেন তা সুনির্দিষ্ট সময়ের আগেও না হয় আবার তা করতে কালক্ষেপন ও না হয়।” এই ব্যাখ্যা থেকে হিকমাহর ঠুনকো দাবীদার ঐসব লোকদের কথার জবাব দেয়া হয় যারা হয় শুধু দুনিয়ার ইলম রাখে অথবা শুধু দ্বীনের অথবা কোনটাই না। তেমনি তাদের বিপক্ষেও এ কথা দলিল যারা উভয় প্রকার ইলম অর্জন করেও আমল করা থেকে হাত গুটিয়ে বসে থাকে। সূরা তাওবায় যাদেরকে বলা হয়েছে ‘ক্বয়িদুন’ বা উপবিষ্টগন।
.
সাইয়্যিদ কুতব তাফসীর ফি যিলালিল কুরআনে বলেন, “নির্ভুলতা ও ইনসাফ কায়েম করা, কাজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুধাবন করা এবং আলোকিত অন্তঃকরনের মাধ্যমে নিজের কথা ও কর্মকে হিদায়াতের দিকে পরিচালনা করাই হিকমাহ।” অর্থাৎ হিকমাহর সাথে ইনসাফ জড়িত এবং এমন আমলও জড়িত যার মাধ্যমে মানুষ হিদায়াত প্রাপ্ত হয়। সেই হিসাবে চুপচাপ নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করা বা দ্বীনী বিধানের বিপরীতে কোন ধরনের নির্লিপ্ততা দেখানো হিকমাহর সম্পূর্ন বিপরীত।
.
অতএব, কেউ যদি হিকমাহর এমন অর্থ করতে যান যার দ্বারা কুটকৌশল, ভান ভনিতা করা, সত্য গোপন করা, অপছন্দনীয় চতুরতা ইত্যাদি উদ্দেশ্য তবে সে নিঃসন্দেহে ভ্রান্তির মধ্যে আছে। কারন এই অর্থ না সাহাবায়ে কেরাম নিয়েছেন আর না ই বা নিয়েছেন পূর্ববর্তীদের কেউ।
.
সর্বোপরি আমাদের কর্তব্য এটাই যে উম্মাহর জন্যে এমন একটি অত্যাবশ্যক বিধানের সঠিক বুঝ সলফে সালেহীন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন, তাবিঈন, তাবে তাবিঈনদের থেকেই নেয়া এবং তদানুযায়ী আমল করা। পাশাপাশি অপব্যাখ্যাকারীদের কুৎসিত চালে বিভ্রান্ত না হওয়া এবং নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের এমন কাজের জবাব দেয়া।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
back to top