শনিবার, ২৮ মে, ২০১৬

শাসক যদি কুফুরী করে এবং এতে অনড় থাকে, তাহলে করনীয় কি???

কোন মন্তব্য নেই:

#প্রশ্ন:শাসক যদি কুফরী করে এবং এতে অনড় থাকে, তাহলে তার সাথে যুদ্ধ করা আবশ্যক কি?????????
.
.
উত্তর:
শাসক যদি কুফরী করে এবং এতে অনড় থাকে, তাহলে তার সাথে যুদ্ধ করা আবশ্যক, এটি ফারদুল আইন। আর অন্য সকল বিষয়ের উপর এটি প্রাধান্য পাবে
.
এই হুকুমটি ঐসব শাসকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যারা বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে শারীয়াহ ব্যতীত অন্য আইন প্রয়োগ করে।
.
তারা আল্লাহ্ তা‘আলার বক্তব্য অনুযায়ী কাফিরঃ

وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ

‘‘আর আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিচার ফয়সালা করে না, তারাই কাফির।’’
[সূরা আল মায়িদাহ:৪৪]
.
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) আরো বলেছেন,

ثُمَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بِرَبِّهِمْ يَعْدِلُونَ

‘‘এতদসত্ত্বেও কাফিররা তাদের রবের সমকক্ষ দাঁড় করায়।’’
[সূরা আল আনআম:১]
.
এছাড়াও আরো অনেক দলীল দ্বারা তারা কাফির প্রতিপন্ন। কিন্তু এদের অধিকাংশই নিজেদের মুসলিম বলে দাবী করে। সুতরাং তাদের কুফরীর কারণে তারা মুরতাদে পরিণত হয়। আর বাস্তব অবস্থা হলো এইসব শাসক যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান বাদ দিয়ে অন্য বিধানে শাসন করে, তারা তাদের ইচ্ছামত যেকোন আইন দিয়ে মানুষদের শাসন করে। অর্থাৎ তারা নিজেদের আল্লাহর পাশাপাশি মানুষের প্রভূ ও দেবতা হিসেবে স্থাপন করেছে, যেমনটি আল্লাহ্ বলেছেন,

أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُمْ مِنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللَّهُ

‘‘তাদের কি এমন কতক শরীক দেবতা আছে যারা তাদের জন্য বিধান দিয়েছে এমন দ্বীনের যার অনুমতি আল্লাহ্ দেননি।’’
[সূরা আশ শূরা:২১]
.
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) বলেন,

اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ

‘‘তারা (ইহুদী এবং খ্রীষ্টানরা) আল্লাহ্ ব্যতীত তাদের পন্ডিত ও সংসার বিরাগীগণকে তাদের রব হিসেবে গ্রহণ করেছে...’’
[সূরা আত-তাওবাহ:৩১]
.
আর তাদের কুফরের মাত্রা আরো বর্ধিত ও দৃঢ় হয় যখন তারা আল্লাহর রাস্তায় বাঁধা প্রদান করে। আর এ ব্যাপারে আরো বিস্তারিত আলোচনা করে ‘আদ দাওয়াহ আত তাওহীদ’ নামক অন্য একটি গ্রন্থে, যেটা মূলত সূরা মায়িদাহ এর ঐ আয়াত সংক্রান্ত কিছু বিভ্রান্তির জবাব দেয়ার জন্য লিখেছি, যেখানে আল্লাহ্ বলেছেনঃ ‘‘আর আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিচার ফয়সালা করে না,
তারাই কাফির।’’
.
আর এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছি যে এ আয়াতটি যেকোন দৃষ্টিকোণ থেকেই একটি স্পষ্ট আয়াত এবং এতে বর্ণিত কুফরটি ‘বড় কুফর’ বা কুফর আল আকবার। আরও ব্যাখ্যা করেছি যে ফিকহের উসূল অনুযায়ী, যখন একজন সাহাবার বক্তব্য কোরআনের ব্যাখ্যার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তখন আমরা সেই বক্তব্যকে গ্রহণ করি যেটি কিতাব আর সুন্নাহ দ্বারা অধিক সমর্থিত।
.
আর তাছাড়া এ বিষয়টিও স্পষ্ট করেছি যে, বিভিন্ন মুসলিম দেশে বিরাজমান বর্তমান পরিস্থিতি এবং এই আয়াত নাযিলের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ এক। যা হলো আল্লাহর শারীয়াহ বাদ দেয়া এবং এর পরিবর্তে নতুন ব্যবস্থা তৈরী করা ও সেগুলোকে আইনে রূপান্তর করে মানুষের উপর তা চাপিয়ে দেয়া, ঠিক যেভাবে ইহুদীরা যেনার শাস্তি পাথর নিক্ষেপকে বাদ দিয়ে নিজেরা পাল্টা আইন দিয়েছিল।
.
আর আমার বইতে আমি এও বলেছি যে, ফিকহের উসূল অনুযায়ী, এই আয়াত নাযিল হওয়ার কারণ সম্পূর্ণরূপে এই আলোচনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
.
ইসমাঈল আল কাযী একথাই বলেছেন। ইবনে হাযার আল আসকালানীর বর্ণনায় পাওয়া যায়, ‘‘আর ইসমাঈল আল কাযী তার আহকাম ‘আল কুরআন’ গ্রন্থে এই আয়াতের বাহ্যিক অর্থ নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘এই আয়াতের বাহ্যিক অর্থ হলো যে ব্যক্তি ঐ কাজ করবে যা তারা (ইহুদীরাঃ যাদের ব্যাপারে এই আয়াত নাযিল হয়েছে) করেছিল এবং নতুন আইন উদ্ভাবন করবে যা আল্লাহর আইনের বিরোধী এবং এটিকে দ্বীনের একটি অত্যাবশ্যক রূপে পরিণত করবে;
সে শাসক হোক আর নাই হোক;
তার ব্যাপারে সেই একই রায় যে রায় বা হুমকি রয়েছে তাদের (ইহুদী) জন্য।’’
.
সুতরাং যারা তাদের সাথে এই বানোয়াট আইনকে আরো পরিবর্ধনের কাজে অংশ নেয় সে একটি কাফির যে কুফর আল আকবার করেছে, যা একজন ব্যক্তিকে ইসলামের মিল্লাত থেকে বের করে দেয়, যদিও বা সে ইসলামের পাঁচটি ভিত্তি এবং আরো অন্যান্য কর্মকান্ড পালন করে। আর এটি বর্তমান সময়ের অধিকাংশ আলেম সমর্থন করেছেন, যা আমি এই বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ে আহমাদ শাকির, মুহাম্মাদ হামিদ আল ফিক্কি ও মুহাম্মাদ বিন ইব্রাহীম আল আশ শাইখ প্রমুখের উক্তি দিয়ে আলোচনা করেছি।
.
আর উপরোক্ত গ্রন্থে আমি ব্যাখ্যা করেছি - ইসলামী শারীয়াহ অনুযায়ী কাদেরকে ‘শাসক’ বলে আখ্যা দেয়া যায়।
.
.
২) আর এই মূরতাদ শাসকের পক্ষে যদি কোন ব্যাখ্যা না থাকে; তাহলে তাকে সত্ত্বর অপসারণ করা অত্যাবশ্যক। আর তাকে বিচারের সম্মুখীন করতে হবে, এতে যদি সে তাওবা করে তাহলে ছেড়ে দেয়া হবে অন্যথায় তাকে হত্যা করতে হবে।
.
আর যদি সে তওবা করে, তারপর তাকে আবার শাসনভার দেয়া যাবে না, এটাই ছিল আবু বাকর ও উমার (রদিয়াল্লাহু আনহু) এর সুন্নাত। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘‘তোমাদের উপর (অনুসরণের জন্য ন্যস্ত) হলো আমার সুন্নাহ এবং আমার পরবর্তী খুলাফায়ে রাশিদীন-এর সুন্নাহ। এগুলোকে আকড়ে ধর মাড়ির দাঁত দ্বারা।’’ [আত তিরমীযী]
.
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘‘আর না উমার না আবু বাকর কেউই কোনদিন কোন মুনাফিককে মুসলিমদের উপর (আমীর) নিযুক্ত করেননি এবং তাদের কোন আত্মীয়কেও নিয়োগ দেননি। আর তারা কোন দিনই সমালোচকদের সমালোচনার ভয়ে আল্লাহর অধিকারে হাত দেননি। বরং তারা যখন মূরতাদদের সাথে যুদ্ধ করলেন এবং তাদের দ্বীনে ফিরিয়ে আনলেন তখন তারা তাদের ঘোড়ায় চড়া ও অস্ত্র বহন করা নিষিদ্ধ করেছিলেন যতদিন না তাদের তাওবার প্রমাণ প্রকাশিত হয়েছিল।
.
সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রদিয়াল্লাহু আনহু) যখন ইরাকের আমীর ছিলেন তখন উমার (রদিয়াল্লাহু আনহু) তাকে বলতেন, ‘তাদের কাউকে নিয়োগ দিও না এবং যুদ্ধের (বিষয়াদির) ব্যাপারে তাদের পরামর্শ নিও না।’ অথচ কিছু বিখ্যাত নেতা ছিলেন তালহা আল আসাদী, আল আকরা ইবনে হাবিস, উওয়াইনা ইবনে হিছ্ন এবং আল আস’আত ইবনে কায়স আল-কিন্দী এবং তাদের মত আরো অনেকে।
.
সুতরাং তাদের ব্যাপারে যখন আবু বাকর ও উমার (রদিয়াল্লাহু আনহু) কোন প্রকারের নিফাকের আশংকা করতেন তখন তারা তাদেরকে মুসলিমদের উপরে দায়িত্ব দিতেন না।’’ [মাজমু আল ফাতওয়া ৩৫/৬৫]
.
.
৩) আর যদি মূরতাদ শাসক একটি বাহিনীকে সাথে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে; তাহলে তাদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করা আবশ্যক এবং তার পক্ষে যে যুদ্ধ করবে সেও তার মতই একজন কাফির।
.
কারণ আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) বলেছেনঃ

وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ
‘‘তোমাদের কেউ তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে সে তাদেরই একজন হবে।’’
[সূরা আল মায়িদাহ:৫১]
.
এখানে ‘তোমাদের কেউ’ শব্দটি শর্তসূচক (ইসমে শার্ত্ত), সুতরাং এর দ্বারা তাদের সকলকেই বোঝায় যারা কাফিরদের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে, এবং তাদেরকে কথায় ও কাজে সমর্থন দেয়।
.
শায়খুল ইসলাম ইমাম আব্দুল ওয়াহ্হাব ও অন্যান্যরা বলেছেন যে ঈমান বিনষ্টকারী বিষয়াবলীর মাঝে একটি হলোঃ ‘‘মুশরিকদের পক্ষ নেয়া এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে তাদের সহায়তা করা। এর প্রমাণ হলো আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা)র বাণীঃতোমাদের কেউ তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে সে তাদেরই একজন হবে। নিশ্চয় আল্লাহ্ যালিম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না।’’
[মাজমু আত তাওহীদ- ইবনে তাইমিয়্যাহ ও ইবনে আব্দুল ওয়াহ্হাব]
.
সুতরাং মুরতাদদের সাথে জিহাদের সাথে সাথে এদের সকলের বিরুদ্ধে জিহাদ চালাতে হবে; যদিও তারা দুই কালেমা উচ্চারণ করে এবং ইসলামের প্রকাশ্য কিছু আমল করে;কারণ তারা এমন কাজ করেছে যা তাদের ইসলামের ভিত্তিকেই নষ্ট করে দিয়েছে। আর আল্লাহ্ তা‘আলা বলেনঃ

الَّذِينَ آَمَنُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ الطَّاغُوتِ

‘‘যারা মু’মিন তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে এবং যারা কাফির তারা তাগুতের পথে যুদ্ধ করে।’’ [সূরা আন নিসা:৭৬]
.
অতএব যে কেউ কাফিরকে তার কুফরীতে কথায় ও কাজে সমর্থন দেবে সেও তাদের মতই কাফির। আর এটাই এই দুনিয়ায় তার ব্যাপারে ফয়সালা কারণ সে ঈমানদার মানুষ ও জিহাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। হয়তোবা সে ভেতরে ভেতরে মুসলিম; এমন কোন বিশেষ কারণ (জোরজবরদস্তি বা জানের হুমকি) থাকতে পারে যা তাকে তাকফিরের পর্যায়ে ফেলে না। আর এটাই হচ্ছে তাদের ব্যাপারে ফয়সালার সুন্নাহ যারা বাঁধা দেয়। অন্য একটি গ্রন্থে আমি এই বিষয়ে বিস্তা-রিত আলোচনা রেখেছি। আর জ্ঞানের এ বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া উচিৎ যাতে, ধ্বংসপ্রাপ্তরা সত্য প্রকাশের পর ধ্বংস হয় আর যারা টিকে থাকার তারা সত্যের উপর টিকে থাকে।
.
.
৪) শাসক যখন কুফরী করে তখন তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অনুমতির দলীল হলো উবাদা ইবনুস সামিত রদিআল্লাহু আনহুর হাদীস।
তিনি বলেন, ‘‘রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে ডাকলেন এবং আমরা বাইয়াত হলাম। তিনি তখন আমাদেরকে যে শপথ গ্রহণ করান তার মধ্যে ছিল- ‘আমরা শুনবো ও মানবো, আমাদের অনুরাগে ও বিরাগে, আমাদের সংকটে ও স্বাচ্ছন্দ্যে এবং আমাদের উপর অন্যকে প্রাধান্য দিলেও যোগ্য ব্যক্তির সাথে আমরা নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দল করবো না।’ তিনি বলেন, যে যাবৎ না তোমরা তার মধ্যে প্রকাশ্য কুফর দেখতে পাবে এবং তোমাদের কাছে এ ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে আল্লাহর সুস্পষ্ট দলীল থাকবে।’’’
[বুখারী ও মুসলিম; সহীহ মুসলিম ইস. ফাউ. হাদীস নং ৪৬১৯]
.
আন নববী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন,
‘‘আল কাযী আইয়াদ বলেন, ‘আলেমগণ এব্যাপারে ইজমা করেছেন যে, কাফিরের হাতে নেতৃত্ব দেয়া যাবে না; সুতরাং তার (নেতা) থেকে যদি কুফরী প্রকাশ পায়, তাহলে তাকে অপসারণ করতে হবে।’’’
তিনি আরো বলেন,‘‘সুতরাং তার থেকে কোন কুফরী বা শারীয়াহ পরিবর্তন বা বিদয়াত প্রকাশ পেলে, তাহলে সে তার দায়িত্ব থেকে খারিজ হয়ে গেল এবং তার আনুগত্যের হক সে হারালো; আর এ অবস্থায় মুসলিমদের জন্য আবশ্যক যে তারা তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, তাকে অপসারণ করবে এবং একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক নিয়োগ করবে যদি তাদের পক্ষে সম্ভব হয়। আর যদি একদল মানুষ ছাড়া অন্য কারো পক্ষে এটি সম্ভব না হয় তবে ঐ দলটিকে রূখে দাঁড়াতে হবে এবং ঐ কাফিরকে অপসারণ করতে হবে। তবে বিদ’আতীর ক্ষেত্রে এটি আবশ্যক নয় যদি না তারা মনে করে যে তারা এটি করতে সক্ষম। অর্থাৎ যদি সত্যিই অক্ষমতা বিরাজ করে তাহলে বিদ্রোহ করা আবশ্যক নয়, তবে মুসলিমদের ঐ ভুমি থেকে অন্য কোথাও তাদের দ্বীন নিয়ে হিজরত করতে হবে।’’
[সহীহ মুসলিম বি শারহ আন নববীঃ কিতাব আল ইমারা ১২/২২৯]
.
লেখকের বক্তব্যঃ আর এই ইজমা, যার কথা ইবনাল কাযী উল্লেখ করেছেন; তার ব্যাপারে ইবনে হাজার বর্ণনা করেছেন যিনি ইবনে বাত্তাল, ইবনে আত তীন, আদ দাউদী প্রমুখের ইজমা রয়েছে এবং ইবনে হাজার স্বয়ং তাতে সমর্থন দিয়েছেন।
.
আর ইবনে হাজার বলেন, যদি শাসক কুফরী করেঃ ‘‘আর এ ব্যাপারে ইজমার সারমর্ম হলো তাকে তার কুফরীর কারণে অপসারণ করতে হবে। সুতরাং প্রতিটি মুসলিমকে এই উদ্দেশ্যে রুখে দাঁড়াতে হবে।’’ [ফাতহুল বারী]
.
.
৫) আর মুসলিমরা যদি এটি করতে অক্ষম হয় তাহলে অন্তত এর জন্য প্রসত্মুতি গ্রহণ করা আবশ্যক।
.
ঠিক এ কথাটিই বলেছেন ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহিমাহুল্লাহ), ‘‘জিহাদে যাবার জন্য অস্ত্র শস্ত্র প্রস্তুতি করা যেমন আবশ্যক; তেমনি অক্ষমতার কারণে জিহাদ বন্ধ থাকলে (এর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা আবশ্যক), কারণ যখন কোন (আবশ্যিক) কাজ অন্য একটি কাজ সম্পাদনের উপর নির্ভরশীল হয়, তখন সেই কাজটিও আবশ্যক হয়ে পড়ে।’’
[মাজমু আল ফাতওয়া ২৮/২৫৯]
.
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেন,

وَلا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا سَبَقُوا إِنَّهُمْ لا يُعْجِزُونَ * وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ

‘‘কাফিররা যেন কখনো মনে না করে যে তারা পরিত্রান পেয়েছে; নিশ্চয় তারা আমাদের অক্ষম করতে পারবে না।
তোমরা তাদের মোকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি প্রস্তুত রাখবে।’’
[সূরা আনফাল ৫৯-৬০]
.
আর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিনবার বলেন, ‘‘নিশ্চয় শক্তি হলো নিক্ষেপ করার মধ্যে।’’ [সহীহ মুসলিম]
.
লেখকের বক্তব্যঃ পূর্বের আলোচনা থেকে আপনারা জানতে পেরেছেন তাগুতদের বিরূদ্ধে মুসলিমদের করণীয় কি এবং এ বিষয়গুলো শারীয়াহসিদ্ধ দলীল থেকে প্রমাণিত; কোন মুসলিমের এই বিষয়গুলোকে প্রত্যাখ্যান করার এখতিয়ার নেই।
.
মূল বক্তব্য হলোঃ ‘‘... আমরা নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দল করবো না।’ তিনি বলেন, যে যাবৎ না তোমরা তার মধ্যে প্রকাশ্য কুফর দেখতে পাবে এবং তোমাদের কাছে এ ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে আল্লাহর সুস্পষ্ট দলীল থাকবে।’’
.
আর আমি আগেই উল্লেখ করেছি যাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার আবশ্যকতার ব্যাপারে ইজমা হয়েছে।
.
আর একারণেই এ ব্যাপারে ইজতিহাদ (পর্যালোচনা) করার কোন অবকাশ নেই যে, তাগুতের সাথে কেমনভাবে আচরণ করতে হবে, কারণ যেখানে কিতাবের দলীল আছে এবং ইজমা হয়েছে সেখানে ইজতিহাদের কোন স্থান নেই। আর কিতাবের স্পষ্ট দলীল ও ইজমা থাকার পরও যে এ নিয়ে ইজতিহাদ করবে সে চরম পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত। এরাই সেই দল যারা পার্লামেন্ট বা শিরক বা এমনই অন্যান্য পন্থায় ইসলাম কায়েম করতে চায়। আর যদি কেউ বলে যে অক্ষমতার কারণে তারা জিহাদ করছে না তাহলে আমরা বলব যে, এ অবস্থায় তোমার জন্য জিহাদের প্রসত্মুতি গ্রহণ করার আদেশ রয়েছে শিরকের পার্লামেন্টে যাওয়ার কোন অনুমতি নেই। আর যদি সত্যিই অক্ষমতা থাকে তাহলে হিজরাত করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। আর সে যদি হিজরত করতেও অক্ষম হয় তাহলে সে একজন দুর্বল মুসলিমরূপে আল্লাহর কাছে দু‘আ করতে পারে; যাদের ব্যাপারে আল্লাহ্ বলেছেন,

الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْ هَذِهِ الْقَرْيَةِ الظَّالِمِ أَهْلُهَا وَاجْعَل لَنَا مِنْ لَدُنْكَ وَلِيًّا وَاجْعَل لَنَا مِنْ لَدُنْكَ نَصِيرًا

‘‘...যারা বলে, ‘হে আমাদের রব! এই জনপদ যাদের অধিবাসীরা যালিম, তা হতে আমাদের বের করে (অন্যত্র) নিয়ে যাও; এবং তোমার নিকট থেকে কাউকে আমাদের অভিভাবক কর এবং তোমার নিকট থেকে কাউকে আমাদের সহায় কর।’’’ [সূরা আন নিসা:৭৫]
.
আর যে পার্লামেন্টে যোগ দেয় তার ব্যাপারে বক্তব্য হলোঃ কোন মুসলিম এটি করতে পারে না কারণ এর দ্বারা গণতন্ত্রের মাঝে তার সন্তুষ্টি প্রকাশ পায়; যেখানে মানুষের হাতে নেতৃত্ব দেয়া হয় এই উদ্দেশ্যে যে এসব প্রতিনিধির সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছাই আইন যা ঐ দেশে কার্যকর হবে। আর এটাই সেই কুফর যার ব্যাপারে আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) বলেছেনঃ

وَلا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ

‘‘...আমরা কেউ কাউকে আল্লাহ্ ব্যতীত রব হিসেবে গ্রহণ না করি।’’
[সূরা আল ইমরান:৬৪]
.
পার্লামেন্টের সদস্যরাই এই আয়াতে বর্ণিত রব (হিসেবে নেয়া হয়)। আর এটাই হলো কুফরের মূল বা গোঁড়া। আর কেউ যদি এ ব্যাপারে অজ্ঞ থাকে তাহলে তাকে এটি জানানো আবশ্যক। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) বলেছেন,

وَقَدْ نَزَّلَ عَلَيْكُمْ فِي الْكِتَابِ أَنْ إِذَا سَمِعْتُمْ آَيَاتِ اللَّهِ يُكْفَرُ بِهَا وَيُسْتَهْزَأُ بِهَا فَلا تَقْعُدُوا مَعَهُمْ حَتَّى يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ إِنَّكُمْ إِذًا مِثْلُهُمْ

‘‘কিতাবে তিনি তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ করেছেন যে, যখন তোমরা শুনবে আল্লাহর আয়াত প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে এবং একে বিদ্রুপ করা হচ্ছে, তখন যে পর্যন্ত তারা অন্য প্রসঙ্গে লিপ্ত না হবে তোমরা তাদের সাথে বসবে না, অন্যথায় তোমরাও তাদের মত হবে।’’
[সূরা আন নিসা:১৪০]
.
সুতরাং তাদের সাথে বসবে এবং তাদের কুফরের সাক্ষী হবে সেও তাদের মত কাফির।
.
.
৬) আর এসব মূরতাদ শাসক ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের সাথে জিহাদ করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফারদুল আইন, শুধুমাত্র তারাই অব্যাহতি পাবে যাদের পক্ষে শারীয়াহ সম্মত ওযর আছে।
.
জিহাদ যে তিনটি ক্ষেত্রে ফারদুল আইন হয় সে ব্যাপারে ইতিপূর্বেই আলোচনা হয়েছে। এর মাঝে একটি হলো যখন কাফির বাহিনী মুসলিম রাষ্ট্র আক্রমন করে। আর এই পরিস্থিতিরই উদয় হয় যখন এসব মূরতাদরা মুসলিমদের উপর শাসন করে।
.
সুতরাং তারাই হলো কাফির বাহিনী যারা মুসলিমদের জমীনে আক্রমন চালিয়েছে, সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ফারদুল আইন। এ সম্পর্কে আল কাযী আইয়াদ বলেন, ‘‘.. আর এ অবস্থায় মুসলিমদের জন্য আবশ্যক যে তারা তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।’’
.
আর এই বক্তব্যটি আরো স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় আল হাফিয ইবনে হাযারের উক্তিতে, ‘‘আর এ ব্যাপারে ইজমার সারমর্ম হলো তাকে তার কুফরীর কারণে অপসারণ করতে হবে। সুতরাং প্রতিটি মুসলিমকে এই উদ্দেশ্যে রুখে দাঁড়াতে হবে।’’ আর এটাই হলো উবাদা ইবনুস সামিত রদিআল্লাহু আনহুর হাদীসের প্রকৃত শিক্ষা।
.
লেখকের বক্তব্যঃ আর এসব তাওয়াঘিতের বিরুদ্ধে জিহাদ করা যে ফারদুল আইন এই জ্ঞানটি এমন একটি জ্ঞান যা প্রতিটি মুসলিমের নিকট পৌছে দেয়া কর্তব্য, যাতে তারা জানতে পারে তাদের প্রত্যেকের উপর আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) (এসব শাসকের বিরুদ্ধে) জিহাদের হুকুম দিয়েছেন। কারণ এসব তাওয়াঘিত সাধারণ মুসলিম ও মুজাহিদিন মুসলিমদের মাঝে ব্যবধানের এক বিরাট প্রাচীর তৈরী করে রাখে, যাতে সাধারণ মানুষের জাহিলিয়াত ও নিস্তব্ধতার আড়ালে তারা ঐসব দৃঢ়পদ মুসলিমদের উপর খুব সহজে আঘাত হানতে পারে। আর এই হুকুমটি যেভাবে এসেছে তা সকল মুসলিমের দিকেই ইঙ্গিত দেয় হোক সে ফাসিক যার উপরে শাস্তি অবধার্য হয়ে পড়েছে, কারণ কোন পাপের কারণে কেউ জিহাদের হুকুম থেকে পরিত্রান পেতে পারে না।
.
সুতরাং যারা দ্বীনের জন্য জিহাদ করছেন তাদের দায়িত্ব হলো সাধারণ মানুষকে জানানোর উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগতভাবে এবং ব্যাপক আকারে দাওয়াহ কার্যক্রমের মাধ্যমে এইসব ব্যবধান সৃষ্টিকারী প্রাচীরগুলো ভেঙ্গে ফেলা যাতে জিহাদ এমন অল্পকিছু মানুষ; যাদের একদিনে বা একরাতে শেষ করে দেয়া সম্ভব; তাদের ব্যাপার না হয়ে সকল মুসলিমের সাথে সম্পৃক্ত একটি বিষয়ে পরিণত হয়। সেইসাথে জিহাদ যেন মানুষের একটি গোষ্ঠীর বিষয় না হয়ে সকল মানুষের সাথে সম্পৃক্ত একটি বিষয়ে রূপলাভ করে। আর এভাবেই পুরো পরিস্থিতি তাওয়াঘিত ও তার বাহিনীর বিপক্ষে চলে যাবে। আর এরপর তাদের কুফর প্রকাশ হয়ে গেলে তারাই জনগনের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,

وَأَخْرِجُوهُمْ مِنْ حَيْثُ أَخْرَجُوكُمْ

‘‘..তোমরাও সেই স্থান থেকে তাদের বহিষ্কার কর যে স্থান থেকে তারা তোমাদের বহিষ্কার করেছে।’’ [সূরা আল বাকারা:১৯১]
.
আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) তাঁর নাবী (সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বলেছেনঃ ‘‘..আর তাদের বহিষ্কার কর যেভাবে তারা তোমাকে বহিষ্কার করেছিল।’’ [সহীহ মুসলিম]
.
সুতরাং তাওয়াঘিত যেমন মিথ্যা দাবী ও জাহিলিয়াত বিস্তারের মাধ্যমে সাধারণ মুসলিমদের থেকে মুজাহিদিন মুসলিমদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে ঠিক একইভাবে জিহাদের আবশ্যকতা সংক্রান্ত শারীয়াহ এর জ্ঞান মানুষের কাছে পৌছে দেয়ার মাধ্যমে তাদেরকেও জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন করা মুসলিমদের জন্য অবশ্য কর্তব্য। আর তারা যেভাবে দৃঢ়পদ মুসলিমদের সম্পদ কেড়ে নিয়েছে, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করেছে, যে কথা আল্লাহ্ কোরআনে উলেলখ করেছেন,

لِلْفُقَرَاءِ الْمُهَاجِرِينَ الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِنْ دِيارِهِمْ وَأَمْوَالِهِمْ

‘‘এই সম্পদ অভাবগ্রস্থ মুহাজিরদের জন্য যারা নিজেদের ঘরবাড়ি ও সম্পত্তি থেকে উৎখাত হয়েছে।’’ [সূরা হাশর:৮]
.
সুতরাং একইভাবে মুজাহিদিন মুসলিমদের কর্তব্য হলো তাওয়াঘিতকে তার সম্পত্তি থেকে উৎখাত করা যা দিয়ে সে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধ করার জন্য সৈন্যবাহিনী পুষতো। এই উদ্দেশ্যেই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরাইশদের উপর দুর্ভিক্ষ দেয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দোআ করতেন।
.
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ বলেন, ‘‘যখন কুরাইশরা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে দমন করেছিল এবং (মানুষকে) আহবান করছিল তাকে অস্বীকার করার জন্য, তিনি বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ্, আমাকে তাদের বিরুদ্ধে ইউসুফের সাতের মতো সাত (বছরব্যাপী দুর্ভিক্ষ) দ্বারা সাহায্য করো।’ অতঃপর তারা এমন এক বছর দ্বারা আক্রান্ত হলো যখন তারা অভাবের কারণে হাড়গোড় ও মৃত (জানোয়ার) খেয়েছিল।’’ [আল বুখারী কর্তৃক বর্ণিত, হাদীস নং ৪৮২২]
.
আর তাগুতকে কোনভাবে টাকাপয়সা দেয়া মুসলিমদের জন্য হারাম, কর বা শুল্ক বা অন্য কোনভাবে; ব্যতিক্রম শুধু একান্ত প্রয়োজন অথবা জোরজবরদস্তির ক্ষেত্রে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,

وَلا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ

‘‘...এবং পাপ ও সীমালংঘনে একে অপরকে সাহায্য করবে না।’’
[সূরা আল মায়িদাহ:২]
.
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) আরো বলেছেন,

وَلا تُؤْتُوا السُّفَهَاءَ أَمْوَالَكُمُ

‘‘তোমাদের সম্পদ যা আল্লাহ্ তোমাদের জন্য উপজীবিকা করেছেন তা নির্বোধদের হাতে অর্পন করো না।’’
[সূরা আন নিসা: ৫]
.
এ কথা জেনে রাখা দরকার যে, এইসব তাগুত সরকারকে শারীয়াহ কখনোই অনুমোদন দেয় না। কারণ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন ,‘‘কেউ যদি এমন কাজ করে যা আমাদের এই ধর্মে (দ্বীনে) নেই তাহলে তা প্রত্যাখ্যান করা হবে।’’ [আল বুখারী]
.
আমি আমার ‘কিতাব ও সুন্নাহর উপর কায়েম থাকার মূলনীতি’ গ্রন্থে ‘ষষ্ঠ নীতি’-তে এ বিষয়ে বর্ণনা করেছি। আর মুসলিমদের কর্তব্য হলো শক্তি প্রয়োগ করে এদের সম্পত্তি দখলের জন্য চেষ্টা করা, যেক্ষেত্রে এটি গণীমত বলে গণ্য হবে; আর চালাকী করে বা অন্য কোন উপায়ে এটি দখল করলে সেটি হবে ‘ফায়’। আমাদের নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুসলিমদের উপকারের জন্য কুরাইশদের সম্পদের দখল নেয়ার উদ্দেশ্যে বাহিনী প্রেরণ করেন যার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ বদরের যুদ্ধ শুরু হয়।
.
সারকথা হলো জিহাদ অল্পকিছু মানুষের বিষয় হিসেবে না রেখে এক সার্বজনীন একটি বিষয়ে রূপান্তর করতে হবে। কারণ এটিকে অল্প কিছু মানুষের মাঝে সীমাবদ্ধ রাখলে প্রতিক্ষীত পরিবর্তন সুফল পাওয়া যাবে না। আর এটা এই কারণে যে পরিবর্তনের একটি নিয়ম আছে, যা হলো,

إِنَّ اللَّهَ لا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ

‘‘আল্লাহ্ কোন সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজ অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে।’’ [সূরা আর রাদ:১১]
.
এর মানে এই নয় যে কোন এলাকার সকল জনগণ এতে অংশগ্রহণ করবে, কারণ এটি অসম্ভব ব্যাপার। এই কথা বলার উদ্দেশ্য হলো যাতে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষ যাতে ইসলাম কায়েমের জন্য প্রচেষ্টা চালায় এবং এটি কায়েমের পর এক আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক শত্রুদের থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়। আর মানুষ যতক্ষণ না এ বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে ততদিন এই জিহাদের পক্ষে অথবা নিরপেক্ষ থাকলেই যথেষ্ট হবে।
.
সাধারণ মানুষকে এই শিক্ষা দিতে হবে যে, কেউ তাগুতের মোকাবিলায় সক্রিয় ভূমিকা রাখতে না পারলেও তারা যেন এই জিহাদের বিপক্ষে অবস্থান না নেয়, তাওয়াঘিতকে সাহায্য না করা ইমানের দাবী। আর যখনই তাওয়াঘিতের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার হবে তখন মুসলিমদের উপর আক্রমন ও তাদের ক্ষতি করার চেষ্টা বৃদ্ধি পাবে। এবং এর মাধ্যমেই প্রতিদিন মুসলিমদের ঘর থেকে ঘরে জিহাদের বাতাস বইতে থাকবে, আর আল্লাহ্ প্রতিশ্রুত সাহায্য আসার পূর্ব পর্যন্ত এই দাওয়াহর সমর্থক বাড়তে থাকবে। নিশ্চয় তিনি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না।
.
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) বলেন,

وَنُرِيدُ أَنْ نَمُنَّ عَلَى الَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا فِي الْأَرْضِ وَنَجْعَلَهُمْ أَئِمَّةً وَنَجْعَلَهُمُ الْوَارِثِينَ * وَنُمَكِّنَ لَهُمْ فِي الْأَرْضِ وَنُرِيَ فِرْعَوْنَ وَهَامَانَ وَجُنُودَهُمَا مِنْهُمْ مَا كَانُوا يَحْذَرُونَ

‘‘আমি ইচ্ছা করলাম সে দেশে যাদেরকে হীনবল করা হয়েছিল তাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে, তাদেরকে নেতৃত্ব দান করতে এবং উত্তরাধিকারী করতে; এবং তাদেরকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় প্রতিষ্টিত করতে, আর ফিরআউন, হামান ও তাদের বাহিনীকে সেই (জিনিস) দেখিয়ে দিতে যা তাদের নিকট তারা আশংকা করত।’’
[সূরা আল কাসাস:৫-৬]
.
.
৭) স্বভাবজাত অন্যান্য কাফিরদের সাথে যুদ্ধের চেয়ে, এসকল মূরতাদ শাসকদের সাথে যুদ্ধ করা অগ্রাধিকার পাবে।
.
প্রথমতঃ এই যুদ্ধ জিহাদ ‘আদ দিফা’য়র’ শ্রেণীভুক্ত; আর এটি ‘জিহাদ আত তালাবের’ উপর অগ্রাধিকার পায়। একে জিহাদ আদ দিফা’য়র শ্রেণীভুক্ত করার কারণ হলো যে, এসব শাসকরা হলো কাফির শত্রু যারা মুসলিম রাষ্ট্রের দখল নিয়ে রেখেছে।
.
আর ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘‘আত্মরক্ষার জন্য যে জিহাদ তা হলো সবচেয়ে জরুরী, যেখানে আগ্রাসী বাহিনীকে পবিত্র ভূমি ও দ্বীন থেকে দূরে বিতাড়িত করা হয়। সুতরাং ইজমা অনুযায়ী এটি অবশ্য কর্তব্য।
.
সুতরাং যেই আগ্রাসী শত্রু এই দ্বীন ও এই জীবনকে কলুষিত করে; ঈমান আনার পর তাদেরকে দমন করার চেয়ে অধিক আবশ্যক আর কিছু নেই।
.
অতএব এক্ষেত্রে কোন শর্ত নেই, সম্ভব যে কোন উপায়ে তাদেরকে দমন করা অত্যাবশ্যক।’’ আর সপ্তম অধ্যায়ের আলোচনায় আমরা জেনেছি, জিহাদ অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে যখন শত্রুরা মুসলিমদের কোন রাষ্ট্রে ঢুকে পড়ে।
.
দ্বিতীয়তঃ মূল বিষয় হলো যে, তারা মূরতাদ। আর চতুর্দশ অধ্যায়ে এ ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে যে স্বভাবজাত কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের চেয়ে মূরতাদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ একটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়।
.
তৃতীয়তঃ আর তাছাড়া এরা মুসলিমদের সবচেয়ে নিকটবর্তী এবং অধিক ফিৎনা ও হুমকিস্বরূপ। আর আল্লাহ্ তা‘আলা বলেনঃ

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا قَاتِلُوا الَّذِينَ يَلُونَكُمْ مِنَ الْكُفَّارِ

‘‘হে মু’মিনগণ কাফিরদের মধ্যে যারা তোমাদের নিকটবর্তী তাদের সাথে যুদ্ধ কর।...’’
[সূরা আত-তাওবাহ ১২৩]
.
#একটি ভুল ধারণাঃ মূরতাদরা ঐ রাষ্ট্রের নিকট বিদেশী নয়; সুতরাং বৈদেশিক আগ্রাসী শক্তির ব্যাপারে যে রায় রয়েছে তা এক্ষেত্রে অকার্যকর।
.
উপরে আলোচিত তিনটি বিষয়ের মধ্যে প্রথমটি নিয়ে অনেকে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। কিছু কিছু ব্যক্তির মতে মুসলিম রাষ্ট্রের এসব মূরতাদদের শাসকদের সাথে বৈদেশিক আগ্রাসী কাফির তুলনা করা সঠিক নয় যে মুসলিম রাষ্ট্র দখল করেছে; যারা মুসলিম দেশ শাসন করছে তারা তো সেই দেশেরই অধিবাসী;
সুতরাং এ দু’য়ের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। আসলে এসব বক্তব্যের উদ্দেশ্য হলো বর্তমান পেক্ষাপটে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহর সেই ফাতওয়াকে অকেজো প্রমান করা, যা তিনি শারীয়াহ বিরোধী তাতারদের ব্যাপারে দিয়েছিলেন যারা নিজেদেরকে মুসলিম দাবী করত। বলা হয়ে থাকে যে এই ফাতওয়াটি এক্ষেত্রে দলীল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না, কারণ তাতাররা মুসলিম রাষ্ট্রসমুহের কাছে ছিল ভীনদেশী। আমি আমার ‘দাওয়াহ আত তাওহীদ’ গ্রন্থে এই ফাতওয়ার ব্যবহারিক দিক নিয়ে আলোচনা করেছি।
.
এই ভ্রান্তির জবাবে আমরা বলতে চাইঃ মূরতাদ শাসকের আলোচনাটি একটি ভিন্ন আলোচনায় উঠে এসেছে, আর তা হলো উবাদা ইবনুস সামিতের (রদিয়াল্লাহু আনহু) হাদীস যাতে বলা হয়েছেঃ ‘‘আমরা যেন আমাদের দায়িত্বশীলদের বিরুদ্ধে না যাই’’। তিনি বলেছেন, ‘‘যাবৎ না তোমরা তার মধ্যে প্রকাশ্য কুফর দেখতে পাবে এবং তোমাদের কাছে এ ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে আল্লাহর সুস্পষ্ট দলীল থাকবে।’’ আর আমি এ হাদীস সংক্রান্ত আলোচনায় বলেছি যে, এই হাদীসের দ্বারা অন্য সকল হাদীস শর্তাধীন হয়ে যায় যেসব স্থানে অত্যাচারী নেতৃত্বের সাথে সবর করতে বলা হয়েছে।
.
যেমন ইবনে আববাস (রদিয়াল্লাহু আনহু) এর বর্ণিত হাদীস যেখানে তিনি বলেছেন, ‘‘কেউ যদি সুলতানের মাঝে এমন কিছু দেখে যা সে ঘৃণা করে, তাহলে সে যেন সবর করে।’’
.
আউফ বিন মালিকের (রদিয়াল্লাহু আনহু) হাদীস, ‘‘না, যতদিন পর্যন্ত তারা তোমাদের মাঝে সালাত কায়েম রাখে।’’
.
আর একারণেই ইমাম বুখারী তার সহীহ গ্রন্থের ‘কিতাব আল-ফিতান’ অধ্যায়ে ইবনে আববাস (রদিয়াল্লাহু আনহু) এর হাদীসের পর উবাদা ইবনুস সামিতের (রদিয়াল্লাহু আনহু) হাদীস উল্লেখ করেছেন, যাতে তার পক্ষ থেকে এই বর্ণিত সীমারেখাটি দৃশ্যমান হয়।
.
আর এইসব শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার আবশ্যকতা স্পষ্ট করতে একজন বোধশক্তিসম্পন্ন মানুষের জন্য এটাই যথেষ্ট।
.
আর আমরা উপরোক্ত তিনটি বিষয়ের উপর আলোকপাত এই কারণে করিনি যাতে ইসলামী শারীয়াহ এর সাথে এই বিদ্রোহের সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠা হয়, কারণ উবাদা ইবনুস সামিতের হাদীসে এটি স্পষ্ট বর্ণিত হয়েছে; আমাদের উদ্দেশ্য বরং ছিল এই হাদীসের বক্তব্যের ব্যাপকতা বোঝানো, যেমন এই জিহাদের উপর গুরুত্ব আরোপ এবং অন্য সকল প্রকারের জিহাদের উপর একে অগ্রাধিকার দেয়া।
.
এই ভ্রান্তির জবাবে আমরা আরো বলতে চাইঃ হুকুমাতের কুফরের ক্ষেত্রে শারীয়াহ এমন কোন দিকনির্দেশনা দেয়নি যাতে দেশী কাফির আর বিদেশী কাফিরের মাঝে পার্থক্য করা যায়।

قَالَ يَا نُوحُ إِنَّهُ لَيْسَ مِنْ أَهْلِكَ إِنَّهُ عَمَلٌ غَيْرُ صَالِحٍ

‘‘তিনি বললেনঃ হে নূহ!
সে তো তোমার পরিবারভুক্ত নয়;
সে অবশ্যই অসৎকর্মপরায়ণ।[সূরা হুদ ৪৬]
.
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,

قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَآَءُ مِنْكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَدًا حَتَّى تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ إِلا قَوْلَ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ لاسْتَغْفِرَنَّ لَكَ وَمَا أَمْلِكُ لَكَ مِنَ اللَّهِ مِنْ شَيْءٍ رَبَّنَا عَلَيْكَ تَوَكَّلْنَا وَإِلَيْكَ أَنَبْنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ

‘‘তোমাদের জন্য ইব্রাহীম ও তার অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। যখন তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিলঃ নিশ্চয় তোমাদের সঙ্গে এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যার ইবাদত কর তার সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নাই;
আমরা তোমাদের মানি না;
তোমাদের ও আমাদের মাঝে সৃষ্টি হলো শত্রুতা ও বিদ্বেষ চিরকালের জন্য;
যতদিন না তোমরা এক আল্লাহতে ঈমান আনো।’’[সূরা মুমতাহিনাহ:৪]
.
তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) আরো বলেছেন,

إِنَّ الْكَافِرِينَ كَانُوا لَكُمْ عَدُوًّا مُبِينًا

‘‘কাফিররা তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’’
[সূরা আন নিসা:১০১]
.
এসব আয়াত থেকে একথা স্পষ্ট যে, মু’মিন ও কাফিরের মধ্যে শত্রুতার একমাত্র ভিত্তি বা কারণ হলো কুফর। আর এটাই এই হুকুমের ভিত্তি, দেশী বা বিদেশী কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। কারণ কাফির যদি তোমার গোত্রের কেউ বা সন্তানও হয় তার পরও তার প্রতি শত্রুতা পোষণ করা অত্যাবশ্যক।
.
সুতরাং এই হুকুমের ভিত্তি কুফর ছাড়া আর কিছুই নয়। আর শত্রুতার মতো শাস্তির বিধানও একই ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত আর তা হলো তাদের কুফর। অর্থাৎ কুফরের বৈশিষ্ট্য তার মাঝে বিদ্যমান থাকার কারণেই তার উপর শাস্তির বিধান হয়েছে, অন্য কোন বৈশিষ্ট্যের কারণে নয়।
.
আর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও এই ভিত্তির কথাই বলেছেন, ‘‘যেকেউ তার দ্বীনকে পরিবর্তন করবে, তাকে হত্যা কর।’’(বুখারী ও মুসলিম)
.
অর্থাৎ তিনি দ্বীন ত্যাগ করার কারণেই তাকে (মূরতাদ) হত্যা করতে বলেছেন; অর্থাৎ ইসলাম গ্রহণের পর কুফরে প্রবেশ করা। আর এটাই এই হুকুমের ভিত্তি। এ বিষয়টি পরিষ্কার হবার পর আমরা বলতে চাই, যে কুফরের কারণে এসব শাস্তির বিধান দেয় হয়েছে- হোক সেটা বন্দীকে হত্যা করা অথবা অবাধ্যদের সাথে যুদ্ধ করা- এই বৈশিষ্ট্য (কুফর) দেশী বিদেশী যে কারো মাঝেই সমানভাবে বিদ্যমান থাকতে পারে। এবং সে যদি কোন রাষ্ট্রে মুসলিমদের কর্তৃত্ব করে, তাহলে সে বিদেশ থেকে আক্রমন করেছে নাকি সেই দেশের নাগরিক হয়ে শাসন করেছে ও পরবর্তীতে কুফর করেছে সেটি কোন বিবেচ্য বিষয় হবে না, কারণ এই যে বিশেষ কারণে (কুফর) এই হুকুম এসেছে তা প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিদ্যমান। আর কোন মুসলিম শাসক যদি দায়িত্বে থাকাকালীন কুফর করে তাহলে এই কুফরের সাথে সাথে মুসলিমদের মধ্য থেকে বের হয়ে যায়; এমতাবস্থায় সে মুসলিমদের নিকট পরদেশী।
.
কারণ আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) বলেছেন,

وَنَادَى نُوحٌ رَبَّهُ فَقَالَ رَبِّ إِنَّ ابْنِي مِنْ أَهْلِي وَإِنَّ وَعْدَكَ الْحَقُّ وَأَنْتَ أَحْكَمُ الْحَاكِمِينَ * قَالَ يَا نُوحُ إِنَّهُ لَيْسَ مِنْ أَهْلِكَ إِنَّهُ عَمَلٌ غَيْرُ صَالِحٍ

‘‘আর নূহ তার প্রতিপালককে সম্বোধন করে বলল, ‘হে আমার রব! আমার পুত্র আমার পরিবারভুক্ত এবং আপনার প্রতিশ্রুতি সত্য,আর আপনি তো বিচারকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিচারক।’ তিনি বললেন, ‘হে নূহ! সে তো তোমার পরিবারভুক্ত নয়। সে অবশ্যই অসৎকর্মপরায়ণ।’’ [সূরা হুদ:৪৫-৪৬]
.
সুতরাং সে কুফরের কারণে তার জাতি থেকে বের হয়ে যায় এবং তাদের কাছে সে পরদেশী হয়ে যায়।
.
যদিও কিছু কিছু ঐচ্ছিক বৈশিষ্ট্যের কারণে শাস্তির তারতম্য হতে পারে; সেক্ষেত্রে আদি কাফির ও ধর্মত্যাগী কাফিরের মধ্যে পার্থক্য করা হয়ে থাকে, কারণ ধর্মত্যাগী কাফিরের শাস্তি গুরুতর, যা চতুর্দশ অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে।
.
প্রধান তিন ইমামের মতে আরো পার্থক্য করা হয় মুহারিব (যুদ্ধরত) কাফির ও শান্তিচুক্তিতে আবদ্ধ কাফিরের মাঝে, যদিও ইমাম শাফে’য়ী এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেছেন। এছাড়াও জিহাদের ক্ষেত্রে নিকটবর্তী ও দূরবর্তী কাফিরের মাঝে পার্থক্য করা হয়েছে, ত্রয়োদশ অধ্যায়ের আলোচনায় এ বিষয়টি উঠে এসেছে।
.
আর এই ক্ষেত্রের দিকেই যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যায়, মূরতাদ শাসকেরা তিনটি ক্ষেত্রেই তুলনায় গুরুতর শাস্তির যোগ্য- ধর্মত্যাগ, যুদ্ধরত থাকা এবং নিকটবর্তী অবস্থান। অপর দিকে আদি কাফির, চুক্তিবদ্ধ কাফির ও দূরবর্তী কাফির কিছুটা দয়া আশা করতে পারে। আর আগেই বলা হয়েছে সকল প্রকার মদই হারাম সেটাকে মদ বলুন, এলকোহল বলুন আর নাবিথ বলুন; আর হোক সেটা আমদানীকৃত বা দেশী; সাদা কিংবা লাল। এসকল কোন বৈশিষ্ট্যই মূল হুকুমকে প্রভাবিত করে না কারণ, এটি একটি মূল কারণকে ভিত্তি করে প্রণীত; সেটা হলো এগুলো সবই নেশার বসত্মু। যতক্ষণ পর্যন্ত এই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকবে ততক্ষন পর্যন্ত এই হুকুম বলবৎ থাকবে, সেক্ষেত্রে অন্য কোন বৈশিষ্ট্য গুরুত্ব পাবে না। আর এখানেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে শাস্তির তারতম্য হতে পারে, যে রমযান মাসে দিনের বেলা মদ্যপান। সেক্ষেত্রে তার উপর সাধারণ শাস্তির সাথে সাথে অতিরিক্ত তা’যির যোগ করা হবে, কারণ রমযান একটি পবিত্র মাস। তবে তার মাঝে মূল কারণটিই অনুপস্থিত থাকতো অর্থাৎ সে যদি নেশাই না করত, তবে তার উপর কোন শাস্তিই বলবৎ হতো না।
.
সুতরাং কেউ যদি পরদেশী কাফির ও স্বদেশী কাফিরের জন্য হুকুমের তারতম্য দাবী করে, সে তো তারই মতো যে আমদানীকৃত মদের সাথে দেশী মদের পার্থক্য করে। সুতরাং ভেবে দেখুন।
.
.
৮) আর এক্ষেত্রে এমন কোন শর্ত নেই যে, মুসলিম মুজাহিদদের একটি ভিন্ন রাষ্ট্র থাকতে হবে।
.
কেউ কেউ এটা দাবী করে থাকে যে ঐ মূরতাদ শাসক ও তার বাহিনীর রাষ্ট্র থেকে আলাদা রাষ্ট্র থাকতে হবে। আসলে এই শর্তটিকে অকেজো করতে ইবনে তাইমিয়্যার (রহিমাহুল্লাহ) সেই ইজমা ভিত্তিক ফাতওয়াটিই যথেষ্ট, যা তিনি মুসলিম রাষ্ট্রে আক্রমনকারী আগ্রাসী শত্রুর সাথে যুদ্ধ করার আবশ্যকতার ব্যাপারে দিয়েছিলেন। অতএব ভেবে দেখুন (ফাতওয়ায় উল্লেখিত) এই অবস্থায় আলাদা রাষ্ট্র কোত্থেকে আসবে?
.
উপরন্তু এটা এমন এক সময় জিহাদ ফরয হয়ে পড়ে, যা আমি সপ্তম অধ্যায়ে বলেছি। আর এই শর্তটির কোন শরীয়া ভিত্তিক দলীল নেই। আর কোন শর্ত যদি আল্লাহর কিতাবে খুঁজে না পাওয়া যায় তবে তা বানোয়াট। সম্মানিত আলেমগণের মধ্যে কেউই এই শর্তের কথা বলেননি।
বলার মধ্যে ইবনে কুদামাহ বলেছেন যে,
যদি আক্রমনকারী কাফিররা মুসলিম রাষ্ট্রের খুব কাছে চলে আসে, তাহলে ঐ এলাকার মানুষদের সেখান থেকে সরে এসে একটি দূর্গে অবস্থান নেয়ার অনুমতি আছে। আর মূরতাদ শাসকের ক্ষেত্রে স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট দলীল আছে।
.
আর তা হলো উবাদা ইবনুস সামিতের (রদিয়াল্লাহু আনহু) হাদীসঃ ‘‘... আমরা নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দল করবো না।’ তিনি বলেন,‘যাবৎ না তোমরা তার মধ্যে প্রকাশ্য কুফর দেখতে পাবে এবং তোমাদের কাছে এ ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে আল্লাহর সুস্পষ্ট দলীল থাকবে।’’
.
আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই হাদীসে বা অন্য কোথাও এমন কোন শর্ত জুড়ে দেননি; আর আহলুল ইলমেরও কেউ এই শর্তের কথা বলেননি; আমি এই হাদীসের ব্যাখ্যায় আল কাযী আল আইয়াদ ও ইবনে হাযারের বক্তব্য উল্লেখ করেছি।
.
এরপরও যদি কেউ এই শর্ত যোগ করেন- ‘‘দু’টি ভিন্ন রাষ্ট্র থাকতে হবে’’- এবং বলেন যে, ‘এটি আকল(বিবেক বুদ্ধি) ও ইসলামী শারীয়াহ দ্বারা প্রমাণিত’; তাহলে সেক্ষেত্রে আমরা বলব আকল কোন কিছুকে হুকুমে পরিণত করতে পারে না যা আমি আমার ‘কিতাব ও সুন্নাহর উপর কায়েম থাকার মূলনীতি’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছি। আর তারা যদি বলে যে এটি ইজতিহাদ, তবে আমরা বলব, এটা যদি ইজতিহাদই হয় তবে এই ইজতিহাদ করার দায়িত্ব তাদের উপর ন্যস্ত হবে যাদের সামরিক অভিজ্ঞতা আছে।
.
কারণ আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) বলেন,

إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا

‘‘নিশ্চয় আল্লাহ্ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন গচ্ছিত বিষয় তার হকদারকে প্রত্যার্পন করতে..।’’ [সূরা আন নিসা: ৫৮]
.
আর ইসলামী শারীয়াহ এর দৃষ্টিতে সংখ্যা বা প্রস্তুতিতে অক্ষমতা ছাড়া এক্ষেত্রে অন্য কোন শর্ত নেই। আর এই সিদ্ধান্তও মুজাহিদদের যে কখন তারা ঐ পর্যায়ে পৌঁছাবে। আর কেউ যদি ঝুঁকি নিয়ে একাই জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়ে তবে সেটাও জায়েয এবং আল্লাহ্ চাইলে সেও পুরস্কৃত হবে, অবশ্য যদি সে কোন মুজাহিদ বাহিনীতে থাকে; তবে সেক্ষেত্রে তাকে আমীরের অনুমতি নিয়ে যেতে হবে।
.
আর একলা জিহাদে বের হবার দলীল হলো আল্লাহর বাণী,

فَقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ لا تُكَلَّفُ إِلا نَفْسَكَ وَحَرِّضِ الْمُؤْمِنِينَ

‘‘সুতরাং আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো, তোমাকে শুধু তোমার নিজের জন্যই দায়ী করা হবে;...।’’ [সূরা আন নিসা:৮৪]
.
এবং ইবনে হাযম বলেন, ‘‘আর কুফ্ফারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে ফাসিক (গুনাহগার) আমীর অথবা সৎকর্মপরায়ণ আমীরের সাথে; আর একজন বিজয়ী ও গাযীর সাথে যেভাবে যুদ্ধ করা হয়ে থাকে একজন ইমামের অধীনে এবং কোন ব্যক্তি যদি সক্ষম হয় তাহলে সে একাও যুদ্ধ করে।’’ (‘আল মুহিল্লী’ খন্ড ৭/২৯৯)
.
লেখকের বক্তব্যঃ তাওয়াঘিতের বিরুদ্ধে এই জিহাদ হলো ফারদুল আইন, সুতরাং কোন ব্যক্তি যদি চায় তবে সে একাও এটি করতে, বিশেষত যদি সে তাদের কারো বিরুদ্ধে (যুদ্ধ করার) সুযোগ পায়। অধিক সংখ্যক কাফিরের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করা তার জন্য আবশ্যক নয়। বরং অধিক সংখ্যক কাফিরের ক্ষেত্রে তার পালানোরও অনুমতি আছে। তখন তার প্রত্যয় যদি দৃঢ় হয় এবং শাহাদাতের নিয়্যত থাকে তবে এটা তার জন্য জায়েয এবং এটাই উত্তমঃ

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْرِي نَفْسَهُ ابْتِغَاءَ مَرْضَاةِ اللَّهِ

‘‘মানুষের মধ্যে এমন লোক আছে যে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নিজেকে বিক্রি করে দেয়...।’’
[সূরা আল বাকারা:২০৭]
.
তবে ফারদ হুকুম হলো একত্রে দলবদ্ধভাবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা, কারণ এর মূল উদ্দেশ্য হলো দ্বীন কায়েম করা- ‘‘... এবং আল্লাহর দ্বীন সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।’’
.
আর ব্যক্তিগতভাবে যুদ্ধ করে এটি অর্জন করা সম্ভব নয়। আর কেউ যখন একটি মুজাহিদ বাহিনীর সাথে যুদ্ধে অংশ নেবে, তখন তার আমীরের অনুমতি ছাড়া সে যুদ্ধে যেতে পারবে না; কারণ আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেন,

إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آَمَنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَإِذَا كَانُوا مَعَهُ عَلَى أَمْرٍ جَامِعٍ لَمْ يَذْهَبُوا حَتَّى يَسْتَأْذِنُوهُ

‘‘... মু’মিন তো তারাই যারা আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলে ঈমান আনে এবং রাসূলের সঙ্গে সমষ্টিগত ব্যাপারে একত্র হওয়ার পর তার অনুমতি ছাড়া বের হয় না।’’
[সূরা আন নূর:৬২]
.
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় অথবা তার ইন্তেকালের পর একদল (জামা’আহ) মুসলিম মূরতাদ শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, তারা কোন আলাদা রাষ্ট্র খোঁজেনি বা সে স্থান ত্যাগ করেনি। উদাহরণস্বরূপ যখন মিথ্যুক আল আসওয়াদ আল আনসি নবুয়্যতের দাবী নিয়ে আবির্ভূত হয়, ইয়েমেন দখল করে ও এর কর্তৃত্ব নেয় , সেই মুহুর্তে ফায়রুয আল দায়লামী তাকে ধোঁকা দেয় যেন সে তারই সমর্থক এবং এই সুযোগে তাকে হত্যা করে। আর এই ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় ঘটেছিল।
.
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বা কোন সাহাবা (রদিয়াল্লাহু আনহু) এর প্রতিবাদ করেননি। কেউ বলেননি, ‘‘অন্য একটি রাষ্ট্রে আলাদা না হয়ে ফায়রুয কিভাবে আসওয়াদকে হত্যা করল?’’ এছাড়াও ইয়াজিদ ইবনে আল ওয়ালিদ এবং একটি বাহিনী, যখন খলীফা আল ওয়ালিদ ইবনে ইয়াজিদের দ্বীনের মাঝে গলদ দেখতে পেয়েছিল তখন তারা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল এবং তাকে হত্যা করেছিল; তারা কোন আলাদা রাষ্ট্র তৈরী করে নেয়নি।
.
.
আলোচনা সংক্ষিপ্ত রাখার স্বার্থে আমরা শুধু এই দুইটি উদাহরণের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাই।
.
যারা এই ভ্রান্তির পক্ষে কথা বলেন তারা দলীল দিয়ে থাকেন যে, রাসূল রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হিজরত করে শত্রু থেকে দূরে মদীনায় আলাদা রাষ্ট্রে যাবার আগে যুদ্ধ শুরু করেননি। কিন্তু এই বক্তব্যের দ্বারা শারীয়া তে এমন কোন শর্ত আরোপিত হয় না যে, এরকম অবস্থা আসার আগে যুদ্ধ করা যাবে না এবং এ বিষয়ে কোন অস্পষ্টতা নেই।
.
আর তাছাড়া ঐ সময়ে শারীয়াহ নাযিল হয়েছে; আর বর্তমানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর শারীয়াহ ও এর হুকুমসমূহ পরিপূর্ণতাপ্রাপ্ত অবস্থায় আছেঃ

الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ

‘‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম..’’
[সূরা আল মায়িদাহ:৩]
.
আর ইজমা হয়েছে যে, যখন শত্রুরা কোন মুসলিম রাষ্ট্রে প্রবেশ করে তখন ঐ জনগণের উপর জিহাদ আবশ্যক হয়ে পড়ে- অর্থাৎ শত্রুকে দমন করা ঐ রাষ্ট্রের মুসলিমদের উপর ফারদুল আইন হয়ে যায়। এক্ষেত্রে কাফির ও মুসলিম একই ভূমিতে অবস্থান করছে কারণ মুসলিম পরাজিত হয়ে আলাদা রাষ্ট্রটি হারিয়েছে। কিন্তু তারপরও ইজমা অনুযায়ী মুসলিমের জন্য ফারদ শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। মূরতাদ শাসকের বিরুদ্ধে জিহাদ করা একটি হুকুম যা সক্ষমতার উপর নির্ভর করে। আর এই সক্ষমতার হিসাব বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন হতে পারে। যাদের এ ব্যাপারে বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে তারাই এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবে। আল্লাহ্ তাবারাক ওয়া তা‘আলা মুজাহিদ বাহিনীর বিশুদ্ধ নিয়্যতের কথা জানলেই তিনি তাদেরকে পরিচালিত করবেন এবং তাদের সেই কাজগুলো সহজ করে দিবেন যাতে তিনি সন্তুষ্ট হন।
.
আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) বলেনঃ

فَعَلِمَ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَنْزَلَ السَّكِينَةَ عَلَيْهِمْ

‘‘...তাদের অন্তরে যা ছিল তা তিনি অবগত ছিলেন; তাদেরকে দান করলেন প্রশান্তি...।’’ [সূরা ফাত্হ:১৮]
.
তিনি আরোও বলেন,

إِنَّ الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ يَهْدِيهِمْ رَبُّهُمْ بِإِيمَانِهِمْ

‘‘...নিশ্চয় যারা মু’মিন ও সৎকর্মপরায়ণ তাদের রব তাদেরকে ঈমানের দ্বারা পথনির্দেশ করবেন।’’ [ সূরা ইউনুস:৯]
.
আর যারা এই ফরয জিহাদ থেকে দূরে থাকে, তাদের এই পশ্চাদপদতা তাদের কোন কাজে আসবে না। বরং তারা অন্যদেরকে জিহাদে যাবার পথে বাঁধা দেয় এবং এসব ভ্রান্তির দ্বারা তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। এটাই তাদের পশ্চাদপদতার শাস্তি; আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,

رَضُوا بِأَنْ يَكُونُوا مَعَ الْخَوَالِفِ وَطُبِعَ عَلَى قُلُوبِهِمْ فَهُمْ لا يَفْقَهُونَ

‘‘তারা অন্তঃপূরবাসিনীদের সঙ্গে অবস্থান করাই পছন্দ করেছে এবং তাদের অন্তরে মোহর এঁটে দেয়া হয়েছে; ফলে তারা বুঝতে পারে না।’’ [সূরা আত-তাওবাহ:৮৭]
.
সুতরাং তারা যখন পেছনে পড়ে থাকে তখন আল্লাহ্ তাদের অন্তরকে সন্দেহের দ্বারা মোহর মেরে দেন। অতএব তারা বিভ্রান্তি খুঁজতে থাকে যাতে তারা তাদের পশ্চাদপদতার স্বপক্ষে যুক্তি দিতে পারে এবং অন্যদেরকেও তাদের সাথে পেছনে ফেলে রাখতে পারে; এভাবে তারা তাদের দায়বদ্ধতার সাথে অন্যদেরও দায়ী করতে চায়। আর এমনিভাবেই একটি পাপ থেকে অন্য পাপের জন্ম হয়। আল্লাহ্ তাবারাক ওয়া তা‘আলা বলেন,

إِلا تَنْفِرُوا يُعَذِّبْكُمْ عَذَابًا أَلِيمًا وَيَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ وَلا تَضُرُّوهُ شَيْئًا وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ * إِلا تَنْصُرُوهُ فَقَدْ نَصَرَهُ اللَّهُ

‘‘যদি তোমরা অভিযানে বের না হও তবে আল্লাহ্ তোমাদের মর্মন্তুদ শাস্তি দিবেন এবং অপর জাতিকে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন; এবং তোমরা তার কোন ক্ষতিই করতে পারবে না। আল্লাহ্ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। যদি তোমরা তাকে সাহায্য না কর তবে আল্লাহ্ তো তাকে সাহায্য করেছিলেন...।’’
[সূরা আত-তাওবাহ: ৩৯-৪০]
.
আর জিহাদের ক্ষেত্রে দু’টি ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্র থাকতে হবে এমন বক্তব্য এক অর্থে জিহাদকেই বাধাগ্রস্থ করে; বিশেষত ‘জিহাদ আদ দিফা’য়’।
এর দ্বিরাষ্ট্র তত্ত্বের অর্থ হলো বর্তমান পরিস্থিতির কাছে নতি স্বীকার করা এবং এইসব তাগুতের শাসনের ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকা যারা মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ শাসন করছে। সেইসাথে এটি ঐ রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষের উপর জিহাদের আবশ্যকতাকেও অস্বীকার করে থাকে। এবং এর দ্বারা কিছু সময়ের জন্য একটি বিশেষ এলাকায় ইসলাম অনুপস্থিত হয়ে পড়ে। আমরা এমন পরিস্থিতি থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই- তবে এটি অবাস্তব নয়- কত স্থানেই তো ইসলামের হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আর আজ অধিকাংশ স্থানেই কুফরের শাসন চলছে। সেসব স্থানে ইসলাম আজ স্মৃতিচিহ্ন হয়ে রয়েছে অথচ একদিন এসব স্থানে ইসলামই ছিল বাস্তব; যেমন আন্দালুসিয়া, তুর্কিস্থান, বুখারা, সমরখন্দ এবং বলকান ও অন্যান্য অঞ্চল। আর কত দেশই না এসব গাদ্দারদের হাতে তাদের ধোঁকাবাজিতে ধ্বংস হয়েছে, যেমন ভারত যেখানে ইসলামী সাম্রাজ্য ছিল যা পরবর্তীতে ইংরেজরা দখল করে নেয়। অসৎ আলেমরা জিহাদকে অস্বীকার করেছিল এই বলে যে, এসব ইংরেজরা উলীল আমর নয়, তাদের মানতে কেউ বাধ্য নয়; কারণ আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,

أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ

‘‘তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর তাঁর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা দায়িত্বশীল তাদের।’’
[সূরা আন নিসা:৫৯]
.
এসব ভ্রান্তির ব্যাপারে মুহাম্মাদ রশীদ রিদা তার তাফসীর ‘আল মানার’-এ আলোচনা করেছেন, আর আল্লাহর কাছেই আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত সমস্ত কর্তৃত্ব। এটি উমার রদিআল্লাহু আনহুর বক্তব্যের একটি জলন্ত প্রমাণ যেখানে তিনি বলেছেন কিসের দ্বারা ইসলাম ধ্বংস হবে, ‘‘... সেই মুনাফিকের যুক্তি দ্বারা যে কুরআন ব্যবহার করে।’’
আর আলেমদের মধ্যে যে কেউ এসব কাফের শাসকদের প্রতি সহমর্মিতার স্বার্থে এমন বিভ্রান্তির দ্বারা মুসলিমদের জিহাদ থেকে বিরত রাখবে, তার কুফরের ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। সে দ্বীনের বাইরে, একজন মূরতাদ, এবং তার রায় আর তার কর্তৃত্বকারী শাসকের রায় একই।
আল্লাহ্ আ’আলা বলেন,

وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ

‘‘তোমাদের মধ্যে কেউ তাদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।’’
[সূরা আল মায়িদাহ:৫১]
.
.
৯) অনেকে বলে থাকেন যে, কাফেরদের বাহিনীর মধ্যে নানা কারণে অনেক মুসলিম মিশে আছে; তাদেরকে পৃথক করতে হবে।
.
আর এমনটি ঘটে থাকে কারণ বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কাফেরদের বাহিনীকে আলাদা করে চেনা যায়; তাদের পোষাক আলাদা থাকে বা তাদের নির্দিষ্ট এলাকা বা ঘাঁটি থাকে যা সহজে চেনা যায়। কিন্তু যদি মুসলিমরা তাদের মধ্যে মিশে থাকে তাহলে প্রথমত তারা ঐ কাফের বাহিনীর অন্তর্গত ছিল না কিন্তু যুদ্ধের ভেতর তারা কোনভাবে তাদের মাঝে মিশে গেছে; অথবা তারা কাফেরদের দলেই ছিল কিন্তু তাদের অন্তরে তারা ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত, যেমন কেউ যদি গুপ্তচরবৃত্তির জন্য তার দ্বীন গোপন করে তাদের মাঝে অবস্থান করে। তাদের অবস্থা নিচের যেকোন দু’টি অবস্থার মাঝে যেকোন একটি হতে পারেঃ
.
প্রথমতঃ তাদেরকে বাইরে থেকে দেখে কাফিরদের থেকে আলাদা করা যায় না; এরকম অবস্থায় যুদ্ধ বন্ধ রাখার কোন অনুমতি নেই।
.
এ ব্যাপারে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ বলেছেন, ‘‘এবং যাকে তারা (কাফেররা) জোর করে তাদের সাথে নিয়ে আসে, তার হিসাব গ্রহণ করা হবে তার নিয়্যতের উপর ভিত্তি করে। আর আমাদের দায়িত্ব হলো পুরো বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করা কারণ যাকে বাধ্য করা হয়েছে তাকে আলাদা করা, সে নিজে (বলা) ছাড়া (অন্য কারো পক্ষে) সম্ভব নয়।
.
আর এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সহীহ হাদীস থেকে, যেখানে তিনি বলেছেন,
‘An army from the people will wage war against this house. So while they are in a barren region from the land, they will be swallowed up.’ So it was asked, ‘O Messenger of Allāh, within them is a compelled one?’ So he said, ‘They will be resurrected upon their intentions.’” – until he said – æAnd in the phrasing of Al-Bukhārī, from ‘Ā’ishah, she said, ‘The Messenger of Allaah (saws) said, ‘An army will battle the Ka’bah. Then when they are in a barren region from the land, their first and their last shall be swallowed up.’ So she said, ‘I said, ‘O Messenger of Allāh, how will their first and their last be swallowed up, while there are their markets and those who are not from them, within them?!’ He said, ‘Their first and their last shall be swallowed up. Then they shall be resurrected upon their intentions.’” – until he said – æSo Allāh, the Most High, destroys the army, which intended to violate His sanctities; both the compelled one within them as well as the one who was not compelled, despite His ability to differentiate between them, while He resurrects them upon their intentions. So how can it be obligatory upon the Mujāhidīn believers to differentiate between the compelled one and those besides them, while they do not know that?! Rather, if a claimer claims that he went out, due to compulsion, then that would not benefit him by his claim alone, as it is narrated that Al-‘Abbās Ibn ‘Abdul-Muttalib said to the Prophet (saws) , when the Muslims took him prisoner on the Day of Badr, ‘O Messenger of Allāh, verily I was compelled.’ So he said, ‘As for your outside, then it was against us, as for your inside, then it is for Allāh (to decide).’”
.
এবং তিনি (রহিমাহুল্লাহ) আরেক স্থানে বলেছেন, ‘‘আমরা জানি না যে কাকে বাধ্য করা হয়েছে বা হয়নি, তাই আমরা পার্থক্য করার সামর্থ্য রাখি না। সুতরাং আমরা যদি আল্লাহর হুকুম পালন করি এবং তাদের হত্যা করি তাহলে আমরা পুরস্কৃত ও দায়মুক্ত হবো আর আল্লাহ্ তাদেরকে নিয়্যত অনুযায়ী বিচার করবেন। অর্থাৎ কেউ যদি বাধ্য হয়ে (তাদের সাথে) আসে এবং প্রতিরোধ করতে অক্ষম হয়, তাহলে কিয়ামতের দিন তাদেরকে তাদের নিয়্যত অনুযায়ীই প্রতিফল দেয়া হবে। তাই দ্বীন প্রতিষ্ঠার জিহাদেই যদি তার মৃত্যু হয়, তাহলে তার মৃত্যু আর মুসলিম বাহিনীর কারো মৃত্যুর মাঝে কোন বিভেদ নাই।’’
.
আমাদের বক্তব্য হলোঃ অন্যান্য অধ্যায়ে আমরা বর্ণনা করেছি যে, ইসলামী শরীয়া অনুসারে কোন কোন শর্ত পূরণ হলে ধরা যাবে একজন মুসলিম বাধ্য হয়ে কাফিরদের কথা অনুযায়ী কাজ করেছে- এবং আমি এটাও বর্ণনা করেছি যে, বর্তমান শাসকপক্ষীয় সাঙ্গপাঙ্গদের প্রায় কারো ক্ষেত্রেই এসব শর্ত প্রযোজ্য হয় না। এবং আমি এটাও উল্লেখ করেছি যে, আলেমদের ইজমা হলো- এসব বাধ্য অবস্থায়ও কোন মুসলিমকে হত্যা করা যাবে না। তাহলে তার ব্যাপারে কি বলা যায় যে কাফিরদের পক্ষ হয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে গুপ্তচর বৃত্তি করে এবং মুসলিমদের হত্যা করে?
.
দ্বিতীয়তঃ যদি শত্রুদের কাতারে এমন কোন মুসলিম দেখা যায় যাকে মুসলিম বাহিনী চিনতে পারে, তাহলে এই অবস্থাকে বলে তাতাররুস। ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘‘বরং মানবজাতির মধ্যে যারা সৎকর্মশীল ও উত্তম , তারাও যদি ঐ কাফিরদের মধ্যে থাকে, এবং তাদেরকে হত্যা করার ঝুঁকি না নিয়ে কাফিরদের আক্রমন করা সম্ভব না হয়, তাহলে তাদের হত্যা করে হলেও যুদ্ধ করতে হবে। কারণ ইমামদের ইজমা হলো, কাফিররা যদি তাতাররুস করে, তাহলে যুদ্ধ না করাটা হবে মুসলিমদের জন্য ক্ষতিকর।
.
সুতরাং কাফিরদের মারতে গিয়ে তাদেরকে আঘাত করে ফেলা আমাদের জন্য জায়েয। এবং এই দুইটি বিশ্লেষণের যেকোন একটি অনুসারে আমরা এমনকি সরাসরী ঐ মুসলিমের দিক থেকেও আঘাত হানতে পারি। কারণ, জিহাদের জন্য যেই মৃত্যুবরণ করবে, এমনকি যখন সে কাফিরদের মধ্যে থেকেও মনে মনে এটাকে ঘৃণা করবে, তাহলেও সে শহীদের মর্যাদা পাবে এবং তাকে তার নিয়্যত অনুযায়ী পূণরুত্থিত করা হবে। এবং একজন মুজাহিদের মৃত্যু থেকে তার মৃত্যু কখনই বেশী ক্ষতিকর হতে পারে না। এবং আল্লাহর ইচ্ছায় জিহাদ করতে গিয়ে মুজাহিদরা মৃত্যুবরণ করতে পারে, অথচ এর পরও জিহাদ যেহেতু ফরয- সেহেতু এই জিহাদে কাফিরদের কাতারে দাঁড়ানো মুসলিমরা মারা গেলে সেটা কিছুতেই আরো বড় কোন ব্যাপার না। এমনকি মহানাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফিৎনার সময়ও যাকে এরকম বাধ্য অবস্থায় যুদ্ধে আনা হয় তাকে তার তরবারী ভেঙ্গে ফেলতে বলেছেন, যাতে তার মৃত্যু হলেও সে যেন যুদ্ধ না করে।
.
আর এই তাতাররুস সংক্রান্ত আরো আলোচনা পাওয়া যাবে ‘আল মুগনি ওয়াশ শারহ্ আল কাবির’ এবং ‘আল মাজমু শারহ আল মুহাথাব’ গ্রন্থে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
back to top