বৃহস্পতিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

বাংলাদেশের ইসলামী দলগুলোর অপরাধ:

কোন মন্তব্য নেই:

বাংলাদেশের ইসলামী দলগুলোর অপরাধ:
.
অপরাধ ইসলামকে আড়াল করার বাংলাদেশের ইসলামি দলগুলোর অপরাধ অনেক। তবে বড় অপরাধ হলো, ইসলামের মূল পরিচয়টি তুলে না ধরার। এ অপরাধ সত্যকে গোপন করার। আর প্রতিটি অপরাধই আল্লাহর আযাব ডেকে আনে।
বাংলাদেশে সে আযাবই কি কম? তারা
যে ইসলামকে পেশ করছে তাতে নামায-
রোযা ও হজ্ব-যাকাত আছে। মসজিদ-
মাদ্রাসা, ওয়াজ-মাহফিল ও ইসলামের
নামে দলগড়ার আহ্বানও আছে। কিন্তু
যেটি নেই তা হলো নবীজী (সাঃ) নিজে
যে ইসলামকে বহু যুদ্ধ ও বহু ত্যাগের
বিনিময়ে বিজয়ী করেছিলেন সেটির
পূর্ণাঙ্গ পরিচয়। মেঘ যেমন সূর্যকে আড়াল
করে রাখে তারাও তেমনই তাঁর আমলের
সে ইসলামকে আড়াল করে রেখেছে।
.
ফলে বাংলাদেশ একটি মুসলিম-প্রধান দেশ
হওয়া সত্ত্বেও সবচেয়ে অপরিচিত হলো
নবীজী (সাঃ)র আমলের সনাতন ইসলাম।
বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে সে
ইসলাম পরিচিতি পেয়েছে মৌলবাদ রূপে।
সেটিকে বলছে, জ্বিহাদীদের ইসলাম।
সাধারণ মানুষ দূরে থাক, প্রধান প্রধান
ইসলামি দলগুলোও সে ইসলাম থেকে
সযত্নে দূরে থাকার চেষ্টা করছে।
পবিত্র কোরআন সিরাতুল মোস্তাকিমের
যে পথ দেখায় সে পথে নামায-রোযা,
হজ্ব-যাকাত ও মসজিদ-মাদ্রাসা যেমন
আছে, তেমনি ইসলামকে বিজয়ী করার
অবিরাম জ্বিহাদও আছে। আছে অর্থ, শ্রম
ও রক্তদানের প্রেরণা। আর সে জ্বিহাদের
প্রেরণাতেই নবীজী (সাঃ) ও তার
সাহাবাগণ মাত্র ২৩টি বছরে ৫০টির বেশী
যুদ্ধ লড়েছেন। যুদ্ধের ময়দানে নবীজী
(সাঃ)কেও ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়েছে,
ভেঙ্গে গেছে তাঁর দাঁত। বিশাল ভূগোল
জুড়ে ইসলাম যেভাবে বিজয়ী হয়েছে,
মুসলমানেরা যেভাবে বিশ্বশক্তি রূপে
প্রতিষ্ঠা ও ইজ্জত পেয়েছে তা তো সে
লাগাতর লড়াই ও কোরবানীর পথ বেয়েই।
.
অথচ বাংলাদেশে ইসলামের সে চিত্র
নেই। নবীজী (সাঃ) ও সাহাবায়ে
কেরামের জীবনে জ্বিহাদ বার বার
আসলেও বাংলাদেশীদের জীবনে সেটি
বিগত ৮শত বছরে খুব একটা আসেনি। তারা
সিরাতুল মোস্তাকিমের জ্বিহাদের
অংশটুকুতে কদম রেখেছেন সে প্রমাণ কম।
হাজি শরিয়াতুল্লাহ, দুদুমিয়া ও
তীতুমিরের ন্যায় মহান ব্যক্তিগণ সে
সনাতন ইসলামের পথে বাংলার
মুসলমানদের নিতে চেয়েছিলেন্, তবে
সফল হননি। ফলে দেশটিতে নামায-রোযা,
হজ্ব-যাকাত ও মসজিদ-মাদ্রাসার বাইরে
এ ইসলাম সামান্যই সামনে এগিয়েছে।
হাজার মাইলের দীর্ঘ পথে প্রাকৃতিক
সৌন্দর্যে ভরা সমতল সবুজ ভূমি যেমন
থাকে, তেমনি দুর্গম পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র
এবং মরুভূমিও থাকে। লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে
পথের সবটুকুই চলতে হয়। এক মাইল বা
আধামাইল পথও যদি বাঁকি থাকে তবে কি
গন্তব্যস্থলে পৌঁছা যায়? বিষয়টি অভিন্ন
সিরাতুল মোস্তাকিমের বেলায়ও। এ পথে
নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাত যেমন আছে,
তেমনি জ্বিহাদও আছে। আল্লাহর
নির্দেশিত সে পথের কোন একটি অংশও
যদি বাদ থেকে যায় তবে কি মহান
আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌছা যায়? সম্ভব হয়
কি জান্নাতে পৌঁছা? কারণে সেখানে
পৌঁছতে হলে তো সবটুকু পথই পাড়ি দিতে
হয়। সাহাবায়ে কেরাম পুরা পথটিই
চলেছিলেন। ফলে মহান আল্লাহর কাছে
প্রিয় বান্দাহও হতে পেরেছিলেন। অথচ
সে পথচলা থেকে ছিটকে পড়েছিল সে
আমলের মোনাফিকরা। তবে পথের
শেষমাথায় পৌঁছার আগেই রোগভোগে
মোমেনেরও মৃত্যু হতে পারে। কিন্তু সে
ক্ষেত্রেও সিরাতুল মোস্তাকিমের
শেষমাথায় পৌছার নিয়েত থাকতে হবে।
মোমেনের জীবনে শুধু নামায-রোযায়
নিয়েত বাঁধলে চলে না, “এ জীবনে বাঁচা-
মরারও নিয়েত থাকতে হয়। আর সে
নিয়েতটিই ধ্বনিত হয়েছিল হযরত ইব্রাহীম
(আঃ) এর মুখে। তিনি বলেছিলেন, “ইন্নাস
সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়াহ ওয়া
মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন।”
অর্থঃ “নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার
কোরবানী, আমার বাঁচা ও আমার মৃত্যু
সবকিছুই আল্লাহর উদ্দেশ্যে।” মোমেন তো
পুরস্কার পায় তার খালেছ নিয়তের জন্যই।
হযরত ইব্রাহীম (আঃ)এর নিয়েতটি
আল্লাহতায়ালার কাছে এতই পছন্দ
হয়েছিল যে তিনি তাঁর নিজের গ্রন্থ আল
কোরআনে নিজের আয়াতগুলির পাশে তার
কথাগুলোও লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। আর
এভাবে কেয়ামত অবধি এটিকে শিক্ষনীয়
করে রেখেছেন প্রতিটি ঈমানদারের
জন্য। নবীজী (সাঃ)র মশহুর হাদীস, “কেউ
ঈমান আনলো অথচ জীবনে জ্বিহাদ করলো
না এবং সে জন্য নিয়েতও করলো না -এমন
ব্যক্তির মৃত্যু হয় মোনাফিক রূপে।” পবিত্র
কোরআনে আল্লাহপাক বলছেন, “হে
ঈমানদারগণ! তোমাদের কি হলো যে যখন
তোমাদেরকে আল্লাহর পথে অভিযানে
(জ্বিহাদে) বের হওয়ার জন্য বলা হয় তখন
তোমরা ভারাক্রান্ত হয়ে জমিন আঁকড়ে
ধর? তোমরা কি আখিরাতের পরিবর্তে
পার্থিব জীবনে পরিতুষ্ট? আখিরাতের
তুলনায় পার্থিব জীবনের ভোগের উপকরণ
তো অতি সামান্যই। যদি তোমরা
অভিযানে (জ্বিহাদে) বের না হও তবে
তিনি তোমাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তি
দিবেন। এবং অপর জাতিকে তোমাদের
স্থলাভিষিক্ত করবেন।” (সুরা তাওবা
আয়াত ৩৮-৩৯)। পবিত্র কোরআনের এ
আয়াতে যে ঘোষণাটিকে স্পষ্টতর করা
হয়েছে তা হলো, জ্বিহাদ থেকে দুরে
থাকার পরিণাম শুধু জাহান্নামের
শাস্তিই নয়, বরং পাওনা হলো, এ পার্থিব
জীবনে অন্যজাতির গোলামীর আযাব।
বাংলার মুসলমানদের জী্বনে এমনি এক
আযাব নেমে এসেছিল ১৯০ বছরের
ইংরেজদের গোলামীর মধ্য দিয়ে। অথচ
মহান আল্লাহতায়ালা অতি সন্তুষ্ট ছিলেন
সাহাবায়ে কেরামের উপর। কারণ তাদের
জীবনে যেমন নামায-রোযা ও হজ্ব-
যাকাত ছিল, তেমনি আল্লাহর দ্বীনকে
বিজয়ী করার লক্ষ্যে লাগাতর জ্বিহাদও
ছিল। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, “এবং
তোমরা তাদের (ইসলামের শত্রুর) বিরুদ্ধে
লড়াই করতে থাকবে যতক্ষণ না ফিতনা
দূরীভূত হয় এবং একমাত্র আল্লাহর দ্বীনই
সামগ্রীক ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।” -(সুরা
আনফাল আয়াত ৩৯)। বাংলাদেশে
আল্লাহর দ্বীন এবং তাঁর শরিয়তি আইন
পরাজিত, বিজয়ীর বেশে বসে আসে
কাফেরদের প্রবর্তিত আইন। এ আইনে সূদও
হালাল, জ্বিনাহও অপরাধ নয় যদি তা
সম্মতিতে হয়ে থাকে। ফিতনা তথা কলহ-
বিবাদ বিরাজ করছে সমগ্র দেশ জুড়ে।
কিন্তু দ্বীন প্রতিষ্ঠার সে লড়াই কই?
আল্লাহর দ্বীনের এত পরাজয়ের মাঝেও
দেশটির আলেম ও সংখ্যাগরিষ্ঠ
মুসলমানগণ আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়ার
কোন বৈধ কারণ বা যুক্তিই খুঁজে পায় না!
কোরআনী হুকুমের এ অবাধ্যতা কি
আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নয়? এমন
বিদ্রোহে কি কোন কল্যাণ আছে? কি এ
দুনিয়ায়, কি আখেরাতে? এমন এক
বিদ্রোহী-কবলিত দেশে ইসলামী দলের
সংখ্যা বাড়ছে, দলগুলির বয়সও বাড়ছে,
কিন্তু ইসলামের বিজয়ের সম্ভাবনাও কি
আছে? পবিত্র কোরআনে মহান
আল্লাহতায়ালা মোমেনের জীবনে যে
তীব্র পরীক্ষার কথা বার বার বলেছেন
সে পরীক্ষাও তাদের জীবনে নেই।
নির্যাতিত না হয়ে তারা বরং সম্মানিত
হচ্ছেন। এমপি হচ্ছেন, মন্ত্রিও হচ্ছেন।
পরীক্ষা তো তাদের জন্যই, যারা বড়
রকমের প্রমোশনের জন্য বিবেচিত।
মোমেনের জীবনে সে প্রমোশনটি আসে
জান্নাত-প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে। পবিত্র
কোরআনে সে পরীক্ষাটি উল্লেখ করা
হয়েছে এভাবেঃ “তোমরা কি মনে করে
নিয়েছো যে এমনিতেই জান্নাতে প্রবেশ
করবে? অথচ এখনও তোমাদের উপর
পূর্ববর্তীদের অবস্থা আসে নাই। তাদের
উপর এসেছিল ভয়ানক অর্থসংকট ও দুঃখ-
কষ্ট। ভয়ে তারা প্রকম্পিত হয়ে উঠতো।
এমনকি রাসূল এবং তাঁর ঈমানদার সহচরগণ
বলে উঠতো, “আল্লাহর সাহায্য কখন
আসবে?” জেনে রাখ আল্লাহর সাহায্য
অতি নিকটে।” -(সুরা বাকারা আয়াত-২১৪)।
.
জ্বিহাদ হলো সমাজ ও রাষ্ট্রের বুকে
ইসলামের বিজয় আনার হাতিয়ার।
মুসলামানদের হাতে এ হাতিয়ারটি তুলে
দিয়েছেন মহান আল্লাহতায়ালা নিজে।
এটিকে বাদ দিলে ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও
বিজয় থেমে যায়, শুরু হয় লাগাতর পরাজয়।
হাত-পা ভেঙ্গে দিলে ব্যক্তির যেমন
প্রতিরোধের সামর্থ থাকে না, তেমন
মুসলমানের জীবন থেকে জ্বিহাদ বিলুপ্ত
হলে শত্রুর হামলার মুখে প্রতিরোধও
থাকে না। আর শত্রুপক্ষ তো তেমনটিই
চায়। কয়েক বছর আগে মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের RAND Corporation একটি
বিশাল রিপোর্ট প্রকাশ করেছে।
ইন্টারনেট থেকে যে কোন ব্যক্তি সেটি
পড়ে দেখতে পারে। RAND Corporation
একটি বিশাল ‘থিংক-ট্যাংক’ গ্রুপ।
মার্কিন সরকারকে তারা নানা বিষয়ে
পরামর্শ দিয়ে থাকে। আর তাদের
পরামর্শকে শুধু মার্কিন সরকার নয়,
পাশ্চাত্য দেশের অধিকাংশ সরকারই
গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
.
ইসলামের উত্থান ও শরিয়তের প্রতিষ্ঠা ঠেকাতে তাদের পরামর্শ অনেক, তবে মূল কথাগুলো হলঃ
.
এক) মুসলিম বিশ্বের সেকুলার সরকার ও
সংগঠনগুলোর সাথে কার্যকর
পার্টনারশিপ গড়ে তুলতে হবে, যেমন
নিবীড় পার্টনারশিপ গড়া হয়েছে
মিশরের হোসনী মোবারক, পাকিস্তানের
আসিফ জারদারি, আফগানিস্তানের
হামিদ কারজাইয়ের সাথে।
.
দুই) মডারেট ইসলামী সংগঠনগুলোকে
যতটা সম্ভব সেকুলারাইজড করতে হবে।
.
তিন) তালেবানদের ন্যায় যেসব সংগঠন
শরিয়তের প্রতিষ্ঠা ও জ্বিহাদে
আপোষহীন, তাদেরকে নির্মূল করতে হবে।
তাদের বিবেচনায় উপমহাদেশের
জামায়াতে ইসলামী তালেবানদের মত
জ্বিহাদী সংগঠন নয়। মার্কিনীদের শত্রু-
জ্ঞান করা দূরে থাক, তাদের নজরে তারা
বরং মডারেট রূপে চিত্রিত হতে উদগ্রীব।
ফলে তাদের টার্গেট, এ সংগঠনটিকে
বেশী বেশী সেকুলারাইজইড করা।
তালেবানদের মত জ্বিহাদী সংগঠনগুলি
রুখবার জন্য নিজেরা সরাসরি ময়দানে না
নেমে বরং এরূপ সংগঠনকে তারা ব্যবহার
করতে চায়। একই কৌশল ভারতীয়দেরও।
ফলে বাংলাদেশে তাদের স্ট্রাটিজী,
আওয়ামী লীগের ন্যায় সেকুলার
সংগঠনগুলোকে শুধু মজবুত করা নয়,
জামায়াতে ইসলামীর ন্যায়
সংগঠনগুলোকে বাঁচিয়ে রাখাও। তাদের
বিশ্বাস, জামাতকে নিষিদ্ধ বা দূর্বল
করা হলে জ্বিহাদী সংগঠনগুলি সে
শূণ্যস্থান দ্রুত দখল করে নিবে। তখন
প্রবলতর হবে জ্বিহাদ এবং বিপন্ন হবে
সেকুলারিজম ও পাশ্চাত্যের স্বার্থ। ফলে
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বা জামায়াতে
ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার নামে
আওয়ামী লীগ বিগত নির্বাচনের আগে ও
পরে যতটা শোরগোল শুরু করছিল সেটি
মার্কিনী ও ভারতীয়দের চাপে থেমে
গেছে। বরং জামায়াতকে সময় দিয়েছে
তাদের সেকুলারাইজেশন প্রজেক্ট নিয়ে
দ্রুত এগিয়ে যেতে। তারই অংশ হিসাবে
জামায়াতের নেতা-কর্মীরা শরিয়ত
প্রতিষ্ঠার কথা এখন আর বলে না। তা
নিয়ে আন্দোলনে নামার কথাও ভাবে না।
বরং দলীয় অনুষ্ঠানে পৌত্তলিক
রবীন্দ্রনাথের “আমার সোনার বাংলা,
আমি তোমায় ভালবাসি..” গানটি তারা
মনের আনন্দে গাচ্ছে। এবং সেকুলারদের
অনুকরণে দল বেঁধে স্বাধীনতার
স্মৃতিস্তম্ভে নগ্ন পদে গিয়ে ফুলের
মালাও দিচ্ছে। উদযাপন করছে ২৬শে
মার্চ ও ১৬ই ডিসেম্বর। অথচ এগুলো হলো
সেকুলারিজমের প্রতিকী রেওয়াজ। কোন
ইসলামি সংগঠনের নেতাকর্মীরা এমন
কাজ করবে তা কি কোন ঈমানদার ভাবতে
পারে? জামায়াতের মত দেশের সর্ববৃহৎ
ইসলামী দলটির সেকুলারিকরণ প্রক্রিয়া
যে কতটা সফল হয়েছে এ হলো তার নমুনা।
ফল দাঁড়িয়েছে, অর্থের জন্য জামায়াতে
নেতাদের এখন আর দেশে-দেশান্তরে
ছুটতে হচ্ছে না। অর্থই এখন তাদের কাছে
ছুটে আসছে। ফলে নিজেদের ৮ টাকার
পত্রিকা তারা ৫ টাকায়ও বিক্রি করতে
পারছে।
.
সেকুলারাইজেশন এবং চেতনার সাথে
গাদ্দারি জামায়াতে ইসলামী যে মার্কিনী
কৌশলে ধরা দিয়েছে তার কিছু প্রমাণ
দেওয়া যাক। জামায়াতের একজন সিনিয়র
নেতা ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক
মার্কিনীদের দাওয়াতে কিছুকাল আগে
যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েছিলেন।
জামায়াতের শরিয়তের প্রতিষ্ঠা করতে
চায় সে অভিযোগ তুলেছিল
সাংবাদিকেরা। জবাবে তিনি
বলেছিলেন, “Shariah law is misinterpreted.
It is about fighting poverty, establishing
social justice and ensuring the rule of
law.” (এ উদ্ধৃতিটি The Washington Times-এ
প্রকাশিত সংবাদ থেকে নেওয়া।)
লক্ষ্যণীয় হলো, শরিয়ত যে মহান আল্লাহর
কোরআনী আইন সে সত্য কথাটি বলার
সাহস তিনি দেখাননি। শরিয়ত নিছক
দারিদ্রমোচন কর্মসূচী নয়, নিছক আইনের
শাসন প্রতিষ্ঠাও নয়, এটি হলো আল্লাহর
আইনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠা। কিন্তু সে
কথাগুলো তিনি বলেননি। আল্লাহ, ইসলাম,
ইমান ও জ্বিহাদের ন্যায় শরিয়াহও একটি
ইসলামি পরিভাষা বা জার্গন যেগুলি
উচ্চারণের সাথে সাথে পুরা দর্শনটিও
চলে আসে, এবং সনাতন ইসলামের প্রতি
প্রবল অঙ্গিকারও প্রকাশ পায়।
মার্কিনীরা তা বুঝে। জনাব রাজ্জাকও
সেটি বুঝেন। তাই ইচ্ছা করেই শরিয়াহ
শব্দটি তিনি এড়িয়ে গেছেন। কথা হলো,
এভাবে ইসলামের সত্য কথাগুলো লুকিয়ে
হয়তো মার্কিনীদের মন জয় করতে
পারবেন। কিন্তু আল্লাহকেও কি খুশি
করতে পারবেন? জামায়াতে ইসলামির
মিডিয়া জগতের গুরু হচ্ছেন জনাব মীর
কাসেম আলী। ঢাকা থেকে প্রকাশিত
“নয়া দিগন্ত” পত্রিকার তিনিই কর্ণধার।
তিনি কোলকাতায় গিয়েছিলেন
আল্লামা ইকবালের জন্মবার্ষিকীর এক
সেমিনারে। সাথে নিয়েছিলেন
কুষ্টিয়ার জনাব অধ্যাপক আবু জাফরকে।
আবু জাফর সাহেব তার বইয়ে লিখেছেন,
জনাব মীর কাসেম সে সেমিনারে
বলেছিলেন, “কবি ইকবাল ও রবীন্দ্রনাথের
মধ্যে পার্থক্য নেই”। এটি তাক লাগানোর
মত কথা। মদ ও মধুর মধ্যে পার্থক্য বুঝতে
বেশী বিদ্যাবুদ্ধি লাগে না। তেমনি
বিদ্যাবু্দ্ধি লাগে না রবীন্দ্রনাথ ও
ইকবালের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে। সেটি
স্কুলের ছাত্ররাও বুঝে। কিন্তু সেটি
জনাব মীর কাসেম আলী বুঝেননি। তিনি
এক সময় ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয়
সভাপতি ছিলেন। ছাত্র শিবিরের এ
নেতা যে কতটা বুদ্ধিবৃদ্ধিক পঙ্গুত্ব নিয়ে
বেড়ে উঠেছেন এ হলো তারা নমুনা।
রবীন্দ্রনাথের দর্শন ছিল “সাহিত্যের
খাতিরে সাহিত্য”। তাই “তালগাছ
একপায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি
মারে আকাশে” তার লেখা এরূপ অসংখ্য
কবিতা ও ছড়ায় প্রচুর ভাব আছে, ছন্দ
আছে, বর্ণনাও আছে। তবে যেটি নাই
সেটি হলো দর্শন। নাই চরিত্র গঠণ বা
মানব কল্যাণে কোন অঙ্গিকার। ফলে
রবীন্দ্রনাথে মত কয়েক শত জন্ম নিলেও
বাঙ্গালীরা যে দুর্বৃত্তিতে বিশ্বে
শিরোপা পাবে তাতে সন্দেহ আছে কি?
কিন্তু ইকবালের কবিতার স্বাদই ভিন্ন।
তিনি তুলে ধরেছেন ইসলামের দর্শন।
কবিতাকে তিনি ব্যবহার করেছেন মুসলিম
উম্মাহর জাগানোর কাজে। ব্যবহার
করেছেন মানবিকতার উৎকর্ষে। তিন
ছিলেন প্যান-ইসলামিক। বৃহত্তর মুসলিম
উম্মাহর খেদমতের বিশাল দায়িত্ববোধে
নিজ মাতৃভাষা পাঞ্জাবীতে সাহিত্য
চর্চা না করে তিনি কবিতা লিখেছেন
ফার্সি ও উর্দুতে। তার দর্শন থেকেই জন্ম
নিয়েছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র
পাকিস্তান- যা সুলতান মুহাম্মদ ঘোরীর
হাতে দিল্লি বিজয়ের পর ভারতবর্ষের
মুসলিম ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
ইকবালের এ বিশাল দিকটি তার কাছে
ধরাই পড়েনি, যেমনটি ধরা পড়ে না
বাংলাদেশের সেকুলারিষ্টদের কাছে।
মাছের যখন পঁচন ধরে তখন সেটির শুরু হয়
মাথা থেকে। তেমনি আন্দোলনেরও। ত্ই
জামায়াতে আদর্শিক পঁচনটি নিছক মাঠ-
পর্যায়ের কর্মীদের নয়, সেটি উপর তলার
নেতাদেরও। ‘প্রথম আলো’ পত্রিকা গত ৪ই
নভেম্বর ২০০৯ তারিখে খবর ছেপেছে,
“এবার জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন
ইসলামী ছাত্রশিবিরের
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে
জাতীয় সংগীত গেয়ে। মূল সংগঠন
জামায়াত এ বছর গঠন করেছে
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংগঠন। বঙ্গবন্ধুকে
স্বাধীনতার স্থপতি বলছেন জামায়াত
নেতারা। ঘটা করে স্বাধীনতা ও বিজয়
দিবসও পালন করছে জামায়াত।”
পত্রিকাটি আরো ছেপেছে, গত ২৫ মার্চ
স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে জামায়াত
আয়োজিত আলোচনা সভায় দলের আমির
নিজামী বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রের স্থপতি
বলেন। পরদিন তিনি বলেন, “মরহুম শেখ
মুজিবুর রহমান সাহেবকে আওয়ামী লীগের
নেতা-কর্মীরা যতটা না শ্রদ্ধা করে,
আমি নিজে শ্রদ্ধা করি তার চেয়ে
বেশি।” প্রথম আলো আরো লিখেছে, “এর
আগে গত ৬ ফেব্রুয়ারি শিবিরের
সমাবেশে জামায়াতের নির্বাহী
কমিটির সদস্য জনাব মীর কাসেম আলী
বলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্ন না
দেখলে আমরা ১৪ কোটি মানুষ বঙ্গীয় এই
ব-দ্বীপে স্বাধীনতা লাভ করতে পারতাম
না।’ অথচ জামায়াত ও তার ছাত্র সংগঠন
ইসলামী ছাত্র সংঘের হাজার হাজার
কর্মী একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে
নির্যাতীত হয়েছে ও নিষ্ঠুরভাবে নিহতও
হয়েছে। এমনকি জনাব গোলাম আযমদের
মত নেতাদের বাড়ী পাহারা দিতে
গিয়েও রাজাকার প্রাণ দিয়েছে। সেসব
শহীদী আত্মা আবার যদি প্রাণ ফিরে
পেতেন এবং এসব নেতাদের আজকের
কথাগুলা শুনতেন তবে কি তাঁরা বিস্মিত
হতেন না? দিন বদলের সাথে সাথে নীতির
বদলও কি এভাবে হয়? একাত্তরে তাদের
নিজেদের যে বিশ্বাস ছিল এটি কি তার
সাথে গাদ্দারি নয়? কথায় বলে, কোন
হিন্দু যখন মুসলমান হয় সে নাকি বেশী
বেশী গরুর গোশত খায়। মাওলানা
নিজামীসহ যেসব জামায়াত নেতারা আজ
নিজেদেরকে আওয়ামী লীগ কর্মীদের
চেয়ে অধিক মুজিবভক্ত রূপে দাবী করছেন
তাদের দশা তো সেটাই। তাদের নীতির
বদল দেখে মনে হয়, আবার যদি একাত্তর
আসতো তবে জনাব নিজামী ও জনাব
কাসেম আলীরা রাজাকার হত্যায়
আওয়ামী লীগের কর্মীদের সাথে কাঁধে
কাঁধ মিলিয়ে ময়দানে নামতো। কারণ
মুজিবভক্তিটি কারো চেতনায় একাকী
আসে না, আসে রাজাকার হত্যার
চেতনাটিও। তবে কথা হলো একাত্তর
আগামীতে ফিরে না এলেও রাজাকারগণ
তথা ইসলামের স্বেচ্চাসেবীগণ তো
বাংলাদেশে বার বার আসবে। কারণ
জ্বিহাদী চেতনার তো মৃত্যু নাই।
রাজাকারের চেতনা তো ইসলামের বিজয়
ও মুসলমানের প্রতিরক্ষায় আত্মত্যাগের
চেতনা। এটি তো সম্মিলিত শয়তানী
শক্তির সৃষ্ট প্রবল জোয়ারের মুখে
সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দাড়াবার চেতনা,
যেমনটি তারা একাত্তরের করেছিল।
ইসলামের বিপক্ষ শক্তির সাথে তাদের
সংঘর্ষ তাই অনিবার্য। সে সংঘর্ষে
ইসলামকে বাঁচাতে তারা আবারও রক্ত
ঢালবে। আগামী দিনের রাজাকার হত্যায়
জামায়াত নেতারা যে সেকুলার শক্তির
সহচর হবে সে প্রস্তুতিই কি চলছে? বরং
সে প্রস্তুতি যে দ্রুত এগিয়ে চলেছে তার
প্রমাণ মেলে জামায়াতপন্থিদের “দিগন্ত
টিভি”এর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে কাদের
সিদ্দিকীকে সম্মানিত অথিতির আসন
দেয়ার মধ্য দিয়ে। অথচ এই কাদের
সিদ্দিকীর ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে
বর্বরতার প্রকান্ড ইতিহাস আছে। সেটি
তার জন্য আজও অতি গর্বের ইতিহাসও।
জীবনের অতীত বর্বরতার জন্য অনুশোচনা
পেশে যে মানসিক সুস্থ্যতা লাগে, সে
সুস্থ্যতাটুকু সে এখনও পায়নি। একাত্তরের
১৬ই ডিসেম্বরের পর ঢাকা স্টেডিয়ামে
হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে
নিরস্ত্র রাজাকারদের হাত-পা বেঁধে
বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সে হত্যা
করেছিল। নৃশংসতায় সত্য-সত্যই সেদিন
বনের হিংস্র পশু বাঘকেও সে অতিক্রম
করেছিল। আওয়ামী ক্যাডাররা তাকে
বাঘা কাদের বলে তো সে কারণেই।
কাদের সিদ্দিকীর সে নৃশংস বর্বরতা
টাইম ম্যাগাজিনসহ বিশ্বের বহু পত্রিকায়
ছাপা হয়েছিল। এটি ছিল সুস্পষ্ট
যুদ্ধাপরাধ, যা বিশ্ববাসীকে সেদিন
নাড়া দিয়েছিল। কথা হলো সে নৃশংসতা
কি জামায়াত নেতাদেরও নাড়া দেয়?
নাড়া দিলে তারা সে যুদ্ধাপরাধীকে
নিজেদের মঞ্চে সাদরে বরণ করে নেয়
কি করে? মদিনার ইহুদীরাও এককালে
নিজেদেরকে আল্লাহর নিজস্ব লোক এবং
নবীদের বংশধর বলে দাবী করতো।
মদিনীবাসীদের শোনাতো,
আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে নতুন নবীর
আগমন অত্যাসন্ন, এবং তিনি এলে তারা
সুদিন ফিরে পাবে। বলতো, তাঁর নেতৃত্বে
তারা বিশাল ভূখন্ড জুড়ে বিজয় পাবে।
সে নবীর সহায়তায় তারা সর্বপ্রথম
এগিয়ে যাবে, সে কথাও মদিনাবাসীদের
জোরগলায় শোনাতো। কিন্তু প্রত্যাশিত
সে নবী(সাঃ) যখন সত্যসত্যই এলেন তখন
আরবের পৌত্তলিক কাফেরদের সাথে
জোট বেঁধে তারা তাঁর হত্যায় ও ইসলামের
নির্মূলে আত্মনিয়োগ করলো। প্রশ্ন হলো,
আজকের বাংলাদেশও যারা
নিজেদেরকে ইসলামের পক্ষের প্রধানতম
দল রূপে দাবী করছে তারা কি সে পথেই
অগ্রসর হচ্ছে?
.
‘প্রথম আলো’ ৪ই নভেম্বরের সংখ্যায়
আরো লিখেছে, ছাত্র শিবিরের সভাপতি
মো. রেজাউল করীম বলেন, “সমাজের
বিভিন্ন দিক আছে, যেগুলোকে উপেক্ষা
করে চলা যায় না। মানুষের উপলব্ধি,
বিশ্বাস ও মনের বিষয়গুলো গ্রহণ করার
মধ্যেই কল্যাণ। এর মধ্যে অন্য কিছু নাই।”
তিনি আরও বলেন, “কট্টর নীতি কেউ পছন্দ
করে না। সারা বিশ্বই এটা থেকে সরে
এসেছে। যারা এটা করবে, তারা সবাই
হারিয়ে যাবে।” প্রশ্ন হলো, সমাজের
বিভিন্ন দিক, মানুষের বিভিন্ন উপলব্ধি
এবং তাদের বিশ্বাস ও মনের বিষয়গুলো
গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে ছাত্র শিবিরের এ
নেতা কি বুঝাতে চান? এটি কি
বাঙ্গালী জাতিয়তাবাদে দীক্ষা
নেওয়া? আম-জনতার বিশ্বাস ও উপলদ্ধির
সাথে ভেসে যাওয়া? তিনি কি
কোরআনের সে আয়াতটি পড়েছেন
যেখানে আল্লাহপাক রাসূল (সাঃ) কে
হুশিয়ার করে দিয়ে বলছেন,”ওয়া ইনতুতি
আকছারা মান ফিল আরদে ইউদিল্লুকা
আন সাবিলিল্লাহ।” অর্থঃ “এবং আপনি
যদি পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষকে অনুসরণ
করেন তবে তারা আপনাকে আল্লাহর
রাস্তা থেকে হটিয়ে ভিন্ন পথে নিয়ে
যাবে।” তাই মুসলমান হওয়ার অর্থ
অধিকাংশ মানুষের মনের বিষয়গুলোকে
কবুল করা নয়, জনতার স্রোতে ভাসাও নয়,
বরং আল্লাহর নির্দেশিত সিরাতুল
মোস্তাকিমকে আঁকড়ে ধরা। অথচ জামাত
ও শিবির নেতা আজ জনতার স্রোতে
ভাসা শুরু করেছেন। ইসলাম কোন কালেই
এরূপ স্রোতে ভাসা লোকদের জন্য
আসেনি। যারা অন্যদের রঙ্গে নিজেদের
রাঙ্গাতে চায় তাদের জন্যও আসেনি।
ইসলাম তো এসেছে তাদের জন্য যারা
সমাজের স্রোত পাল্টে দেওয়ার হিম্মত
রাখে। আরো প্রশ্ন, ইসলামের কট্টরতা
বলতে এ শিবির নেতা কি বুঝেন? সেটি
নিশ্চয়ই জ্বিহাদ এবং জ্বিহাদের ময়দানে
মানব হত্যা? অথচ নামায-রোযার ন্যায়
জ্বিহাদও ইসলামের বিধান। মুসলমান তাই
শুধু নামায-রোযাই পালন করে না,
ইসলামের শত্রুদের তারা নিজ হাতে হত্যা
করে এবং নিজেরাও নিহত হয়। সাহাবায়ে
কেরাম তো একাজই করেছেন। প্রকৃত
ঈমানদারদের তো এটিই প্রিয় কাজ। এ
কাজ প্রিয় আল্লাহতায়ালারও। মুসলমান
হওয়ার অর্থ ইসলামের শত্রুর গলায় মালায়
ফুলের মালা চড়ানো নয়, তাদের মুখে চুমু
খাওয়াও নয়। অসংখ্য শত্রু হত্যায় অতুলনীয়
বীরত্বের কারণে খালেদ বিন ওয়ালিদ
সম্মানিত হয়েছেন সাইফুল্লাহ বা
আল্লাহর তরবারি রূপে। পবিত্র কোরআনে
আল্লাহতায়ালা মুমিনকে সংজ্ঞায়ীত
করেছেন এ পরিচয়েঃ “ফাইয়াকতুলুনা ওয়া
ইয়ুকতালুন” অর্থঃ “অতঃপর তারা
(শত্রুদের) হত্যা করে এবং নিজেরাও
নিহত হয়”। কথা হলো, সমগ্র বিশ্বে
কঠোরতা বা নিষ্ঠুরতা চালিয়ে যাচ্ছে
তো মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। তারাই দুই-
দুইটি আণবিক বোমার ব্যবহার করেছে।
ইরাকে তারা ১০ লাখ মানুষ হত্যা করেছে।
লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে
ভিয়েতনামে। অবিরাম মানব হত্যা
চালিয়ে যাচ্ছে আফগানিস্তানে ও
পাকিস্তানে। জামায়াতের বর্তমান
ভূমিকা দেখে বুঝা যায়, একাত্তরে
রাজাকারেরা ইসলামের যে জ্বিহাদী
চিত্রকে পেশ করেছিল সেটিকেই এখন
তারা আড়াল করতে চায়। এবং সেটি
মার্কিনীদের খুশি করতে। আল্লাহকে
খুশি করা এখন আর তাদের প্রায়োরিটি
নয়।
.
তবে জামায়াতের এ বিচ্যুতি শুধু
মাওলানা নিজামী বা মীর কাসেম
আলীর মত নেতাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এ
স্খলন আরো সিনিয়র নেতাদের মাঝে।
সেটি শুরু জনাব গোলাম আযমের মত
নেতাদের থেকে। ১৯৭১ সালে তিনি এক
বিবৃতিতে বলেছিলেন, ” পূর্ব
পাকিস্তানীরা পাকিস্তানের
সার্বভৌমত্ব নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী
ভারতকে ছিনিমিনি খেলতে দিবে না।…
পূর্ব পাকিস্তানীরা কখনো হিন্দু ভারতের
দ্বারা প্রভাবিত হবে না। ভারতীয়রা কি
মনে করেছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের
জনগণের এতদূর অধঃপতন হয়েছে, তারা
ভারতকে তাঁদের বন্ধু ভাববে?” (সুত্রঃ
দৈনিক সংগ্রাম, ৮ই এপ্রিল, ১৯৭১)। এ
বিবৃতিতে জনাব গোলাম আযম ভারতকে
বন্ধু ভাবা এবং পূর্ব পাকিস্তানের
অভ্যন্তরে ভারতীয় হস্তক্ষেপকে মেনে
নেওয়াকে নৈতিক অধঃপতন বলেছেন।
অথচ প্রশ্ন হলো জনাব গোলাম আযম কি
নিজে সে নৈতিক পতন থেকে রক্ষা
পেয়েছেন? ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের
সার্বভৌমত্বের উপর হস্তক্ষেপ হয়েছে
এবং সে হস্তক্ষেপের ফলেই
বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছে। এখন জনাব
গোলাম আযম লিখছেন, “ইংরেজদের
গোলামী থেকে আমরা ১৯৪৭য়ে মূক্তি
পেয়েছি। ১৯৭১ সালে পাঞ্জাবীদের
থেকে স্বাধীন হয়েছি। (সুত্রঃ
বাংলাদেশে ইসলামি ঐক্য প্রচেষ্ঠার
ইতিহাস, পৃষ্ঠা ১০৪, ২০০৬; কামীয়াব
প্রকাশন, আযাদ সেন্টার, ৯ম তলা, ৫৫
পুরোন পল্টন, ঢাকা-১০০০)।
.
কথা হলো, ১৯৭১
সালে বাংলাদেশের সৃষ্টি যদি তার
কথিত পাঞ্জাবাদীদের শাসন (?) থেকে
স্বাধীনতাই হয়ে থাকে তবে সে
স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি নিজে কোথায়
ছিলেন? তিনি ও তাঁর দল কি তখন
পাকিস্তানের পক্ষ নেয়নি? জামায়াতের
নেতা থাকাকালীন সময়ে তিনি কি ১৪ই
আগষ্টকে স্বাধীনতা দিবস রূপে উদযাপন
করেননি? এতদিন পর তিনি সে কথাগুলোই
বলছেন যা আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য
ভারতপন্থিরা এতদিন বলে আসছে। এটি
কি তাঁর নতুন এক রাজনৈতিক আদর্শে
দীক্ষা তথা পলিটাল কনভার্শন? পুরা
পাকিস্তানী সময়টি জুড়ে তিনি কি
বিভ্রান্তীর শিকার ছিলেন? প্রশ্ন হলো,
তিনি এখন যে মতটি রাখেন সেটি আর
কতদিন পর পাল্টাবেন?
.
জামায়াতের নেতাগণ একের পর এক অসত্য
ভাষণে সমগ্র দেশবাসীকে অবাক করে
চলেছেন। নিজেদের সন্তান, নিজদলীয়
কর্মী-সমর্থক ও আপনজনদের কাছে
চিহ্নিত হচ্ছেন মিথ্যাচারি রূপে। কারণ
একাত্তরে তাদের ভূমিকা কি ছিল সেটি
অন্ততঃ তাদের নিজ সন্তান, দলীয় কর্মী
ও আপনজনদের কাছে অজানা থাকার
কথা নয়। জানে দেশবাসীও। কথা হলো,
আল্লাহর কাছেই বা তারা কি জবাব
দিবেন? একাত্তরে প্রকাশিত দৈনিক
সংগ্রামের পাতাগুলো উল্টালে তাদের
দলীয় নীতি ও কর্মকান্ড কারো অজানা
থাকার কথা নয়। তাদের বিরুদ্ধপক্ষ
সেগুলো নিয়মিত প্রকাশও করছে। ফলে
তারা যে মিথ্যা বলছে তার সাক্ষী
তারা নিজেরাই। ফলে দেশের শিশুদের
কাছেও তাদের নিজেদের মিথ্যাচার
গোপন থাকছে না। একাত্তরে
জামায়াতের দুইজন নেতা মাওলানা ইউসূফ
আলী এবং আব্বাসআলী খান গভর্নর ডাঃ
মালেক এর মন্ত্রীসভায় মন্ত্রী ছিলেন
এবং তাদের হাজার হাজার কর্মীরা
রাজাকার ও আল-বদর হিসাবে
পাকিস্তানের পক্ষে লড়াই করেছে, বহু
হাজার শহিদও হয়েছে। জামায়াতের
নেতা-কর্মীগণ কি তা অস্বীকার করতে
পারেন? অথচ তাদের মুখে এখন উল্টো সূর।
তার কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক। দৈনিক
প্রথম আলো তার ১৬/১২/০৯ তারিখে খবর
ছাপেঃ আজ বুধবার বিজয় দিবস উপলক্ষে
ঢাকা মহানগর জামায়াত আয়োজিত
আলোচনা সভায় মহানগর জামায়াতের
আমির রফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘রক্ত
দিয়ে, জীবন দিয়ে আমরা স্বাধীনতা
ছিনিয়ে এনেছিলাম।’ ঐদিনের দৈনিক
সংগ্রামও একই রূপ রিপোর্ট করেছে। প্রথম
আলো আরো খবর দিয়েছে, আগের দিন
দলের সেক্রেটারি জেনারেল আলী
আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ বলেন, ‘আমরা
স্বাধীনতা এনেছি। প্রয়োজনে রক্ত দিয়ে
হলেও স্বাধীনতা রক্ষা করব।’ কথা হলো,
এটি কি জামায়াত নেতাদের
সত্যবাদিতার নমুনা? তারা নিজেরাও কি
এসব বিশ্বাস করেন? অন্য কেউ কি একথা
বিশ্বাস করবে? একাত্তরে পূর্ব
পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারের
মন্ত্রী হয়ে কি বাংলাদেশের
স্বাধীনতায় রক্ত দেওয়া যায়? হযরত আলী
(রাঃ) বলতেন, “মানুষের ব্যক্তিত্ব তার
জ্বিহবাতে।” অর্থ্যাৎ সত্যবাদীতায়।
এটিই ব্যক্তির শ্রেষ্ঠ গুণ। নবীজী (সাঃ)
এগুণের বলেই এমন কি কাফেরদের কাছেও
আল আমীন বলে পরিচিত ছিলেন। চরিত্রে
বিপ্লব আনার জন্য সত্যবাদীতাই হলো মূল
ভিত্তি বা ফাউন্ডেশন। ভিত্তি বা
ফাউন্ডেশন ছাড়া যেমন প্রাসাদ গড়া
যায় না, তেমনি সত্যবাদীতা ছাড়া চরিত্র
গড়া যায় না। নবীজী (সাঃ) সাহাবাগণ
অর্থশালী ছিলেন না, কিন্তু
সত্যবাদীতায় অতুলনীয় ছিলেন। ফলে
শ্রেষ্ঠ সভ্যতার জন্ম দিতে পেরেছিলেন।
অথচ মিথ্যাবাদী রূপে চিত্রিত হলে
ব্যক্তির মূল্যমান ও তার উপর অন্যদের
আস্থা হাওয়ায় হারিয়ে যায়। সে আস্থা
বিপুল অর্থ ব্যয়েও ফিরিয়ে আনা যায় না।
তার উপর তখন আস্থা হারান মহান
আল্লাহও। মিথ্যাচারিতা হলো সকল
পাপের জননী, এর গর্ভে জন্ম রকমারি
পাপ। সৎলোকের শাসন এবং ন্যায়নীতির
জন্ম কখনোই মিথ্যাচারেরর মধ্যে ঘটে
না। কথা হলো, এমন মিথ্যাচারিতায় কি
আল্লাহর সাহায্য আসে? জামায়াত কি
ভাবছে যে এভাবেই তারা ইসলামের
বিজয় আনবে? ইসলামের বিজয় আনার
দায়িত্ব কোন ব্যক্তির নয়, কোন দলেরও
নয়। সে দায়িত্ব একমাত্র মহান আল্লাহর।
যে দায়িত্বটি ঈমানদারের উপর তা হলো,
সেটি ইসলামের পূর্ণ অনুসরণের। দায়িত্ব
হলো, ইসলামের বিজয়ে জানমালের
কোরবানী পেশ করা। তাই রাষ্ট্রে
ইসলামের বিজয় আনায় ব্যর্থ হওয়াটি
কোন অপরাধ নয়, ব্যর্থতাও নয়। সে
ব্যর্থতার জন্য সে কোন শাস্তিও পাবে
না। সে পুরস্কার পাবে আত্মত্যাগের জন।
কিন্তু মহা-অপরাধ হলো মিথ্যাবাদী
হওয়া। আর সেটি ঘটি ইসলামের বিজয়
আনার তাড়নায় নয়, বরং দলকে বিজয়ী
করা এবং দলের নেতাদের মন্ত্রী-এমপি
করার তাড়না থেকে। এমন তাড়নার
পিছনে যেটি কাজ করে তা হলো
নিজেদের পার্থিব স্বার্থ চেতনা। আর
এমন পার্থিবতা বা ইহজাগতিক
স্বার্থচেতনাকেই বলা হয় সেকুলারিজম।
সেকুলারিজমের মূল কথা, রাজনীতি
নিয়ন্ত্রিত হবে পার্থিব স্বার্থ চেতনা
থেকে। এবং চায়, ধর্মকর্ম, সত্যবাদীতা
বা পরাকালের স্বার্থচেতনা সীমিত
হোক মসজিদে বা জায়নামাজে।
জামায়াত আজ সে পথেই অগ্রসর হচ্ছে।
ফলে গুরুত্ব পাচ্ছে, জনগণের কাছে
গ্রহণযোগ্য হওয়ার বিষয়টি। কারণ, এ পথে
ভোটের সংখ্যা বাড়ে। গণমুখী সেকুলার
রাজনীতিতে এভাবেই সত্যমুখীতা ও
পরকালমুখীতা বাদ পড়ে যায়। দলকে
প্রতিষ্ঠিত করা, দলের নেতাদের এমপি
করা বা মন্ত্রী করা সফলতা বা বিজয়
বলে মনে হয়।
.
টার্গেট জ্বিহাদকে ভূলিয়ে দেওয়া
ইতিহাসের শিক্ষা অনেক। এবং অন্যতম
শিক্ষা হলো, নিছক নামাযী, রোযাদার
বা হাজীদের সংখ্যা বাড়লেই ইসলামের
প্রতিষ্ঠা বাড়ে না। বিজয়ও আসে না।
বাংলাদেশে তাদের সংখ্যা কি আজ
কম? কিন্তু সে বিজয় কই? বাংলাদেশের
একটি থানায় যত নামাযীর সংখ্যা,
নবীজীর সময় সমগ্র মুসলিম রাষ্ট্রে কি এত
নামাযী ছিল? কিন্তু এসব নামাযী কি
মুসলমানদের ইজ্জতে তিল পরিমাণও বৃদ্ধি
ঘটিয়েছে? বরং বাড়িয়েছে তো তলাহীন
ঝুড়ি ও দুর্নীতিগ্রস্ত জাতির অপমান।
জ্বিহাদ হলো পূর্ণতর ঈমানের প্রকাশ।
পাড় উপচানো প্লাবন দেখে দূর থেকেই
বোঝা যায়, নদীতে পানির বান ডেকেছে।
তেমনি ব্যক্তির জীবনে জ্বিহাদী
আয়োজন দেখেই বোঝা যায়, প্রাণে
ঈমানের জোয়ার এসেছে। আর এ জোয়ারে
ভেসে যায় পাপাচার। যে ব্যক্তি তার
নিজের প্রাণদানে দু’পায়ে খাড়া সে কি
দূর্নীতির বা দুনিয়াদারির কাছে
নিজেকে বিক্রি করতে পারে?
.
দূর্নীতিমূক্ত পবিত্র সমাজ নির্মিত হয় তো
এভাবেই। অথচ ইসলামের এমন বিজয় বা
এমন পবিত্র সমাজের নির্মাণ শয়তানি
শক্তির আদৌ কাম্য নয়। কারণ তা হলে
মুসলিম দেশে তাদের পাপাচারপূর্ণ জীবন
অসম্ভব হয়ে পড়বে। এ জন্যই মুসলমানের
চেতনা থেকে জিহাদ বিলুপ্ত করায়
শয়তানী শক্তির এত আগ্রহ। অপর দিকে
আল্লাহর নির্দেশ এবং সে সাথে রাসূলের
মহান সূন্নত হলো নামায-রোযার ন্যায়
জ্বিহাদকেও সর্ব-সাধারণের স্তরে নিয়ে
যাওয়া। তাই খোলাফায়ে রাশেদার সময়
মুসলমানদের কোন সেনানিবাস ও
বেতনভোগী সৈন্য ছিল। ঈমানদারের
প্রতিটি ঘরই হলো সেনানিবাস। এবং
ঘরগুলি হলো পাঠশালা। যেদিন থেকে
সেনানিবাস নির্মাণ শুরু হলো সেদিন
থেকেই ইয়াজিদ ও আকবরের ন্যায়
দুর্বৃত্তরা মুসলমানদের শাসক হতে শুরু
করলো। মিরজাফরদের মত গাদ্দারেরা
জেনারেল বা সেনাপতি হওয়ার সুযোগ
পেল। আজও সেটিই চলছে। অথচ ঘরে ঘরে
জ্বিহাদ চর্চা শুরু হলে তখন ইসলামের
বিজয়ও শুরু হয়। তার উদাহরণ আজকের
আফগানিস্তান। তারা সোভিয়েত
রাশিয়ার ন্যায় একটি বিশ্বশক্তিকে
দুনিয়া থেকে বিদায় দিয়েছে। আরেক
বিশ্বশক্তিকেও ফেলেছে দিশেহারা
অবস্থায়। এটিকেও যে তারা অচীরে
পরাজিত করে ছাড়বে সে আলামত এখন
প্রচুর। প্রেসিডেন্ট ওবামা সেখানে এখন
নতুন সৈন্য পাঠাতেই ভয় পাচ্ছেন। ব্রিটিশ
সরকারের উপর প্রচন্ড চাপ পড়ছে, দ্রত
গতিতে সৈন্য ফেরত আনার। শয়তানি
শক্তির মূল টার্গেট এজন্যই নামায-রোযা
বা হজ্ব-যাকাতের বিধান নয়। বরং
জ্বিহাদের বিধান। নামায-রোযার
বিরুদ্ধে কোন আলেমকেই তারা ময়দানে
নামায়নি, কোন গোলাম আহম্মদ
কাদিয়ানীরও জন্ম দেয়নি। বরং তাদের
জন্ম দিয়েছে জ্বিহাদ থেকে মুসলমানদের
ঠেকাতে। একাজে নিজেদের খরচে
মাদ্রাসাও খুলেছে। কলিকাতা
মাদ্রাসার ন্যায় অসংখ্য মাদ্রাসা
ভারতে গড়ে উঠেছে তো এভাবেই। আর
এভাবে যতই বেড়েছে এধরণের মাদ্রাসা,
মুসলিম চেতনা থেকে ততই বিলুপ্ত হয়েছে
জ্বিহাদের ধারণা। এসব মাদ্রাসার
শিক্ষকদের ধারণা যে কতটা
বিভ্রান্তপূর্ণ তার এক উদাহরণ দেয়া যাক।
ঢাকায় অবস্থিত জামায়াতে ইসলামির
তামীরুল মাদ্রাসার প্রধান মাওলানা
কামাল উদ্দিন জাফরী সম্প্রতি বিলেতে
বিভিন্ন শহরে ওয়াজ মহফিল করছেন।
তিনি বাংলাদেশে এবং সে সাথে
সৌদিআরবে লেখাপড়া করেছেন। তিনি
বলছেন, “জ্বিহাদ হলো শান্তি।” লন্ডনে
জামায়াতপন্থিদের পত্রিকা “সাপ্তাহিক
ইউরোবাংলা” তার সে বক্তব্যকে আবার
প্রচারও করছে। জ্বিহাদ যে ইসলাম ও
মুসলমানদের উপর শত্রুপক্ষের হামলার
বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী লড়াই সে কথাটি
তিনি আড়াল করে চলেছেন। আর এভাবে
আড়াল করে চলেছেন আল্লাহর গুরুত্বপূর্ণ
এক ফরজ হুকুমকে।
.
প্রতিটি বিজয় আসে মহান
আল্লাহতায়ালা থাকে। আল্লাহতায়ালার
হুকুম ছাড়া গাছের একটি পাতাও পড়ে না।
আর সাহায্য এলে ক্ষুদ্র পাথর টুকরাও
বিশাল বোমায় পরিণত হয়। ক্ষুদ্র মশা
পরিণত হয় মিজাইলে। এমন বোমার
আঘাতে মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র
কাবার উপর হামলাকারি বাদশাহ
আবরাহার বিশাল হাতি-বাহিনীকে
নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন। মিজাইলরূপী
মশার আঘাতে নিহত হয়েছিল নমরুদ। তবে
এধরণের সাহায্য প্রেরণের আগে
আল্লাহতায়ালা বান্দাহর জানমালের
বিণিয়োগটিও দেখতে চান, নিছক দোওয়া-
দরুদ নয়। সমগ্র মানব-ইতিহাসে নবীজী
(সাঃ) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের
কোরবানী ছিল অতুলনীয়। ফলে তাঁরা
মহান আল্লাহর অতুলনীয় সাহায্যও
পেয়েছিলেন। প্রাণে প্রকৃত ঈমান এলে
আল্লাহর পথে আত্মত্যাগও আসে। আর
আত্মত্যাগ এলে, মহান আল্লাহর সাহায্যও
আসে। তখন বিজয়ও অনিবার্য হয়। প্রশ্ন
হলো, বাংলাদেশের ইসলামী দলগুলোর
নিজেদের সে বিণিয়োগটি কই? তারা
ইসলামী আন্দোলনে যা কিছু দিয়েছেন
তা থেকে নিয়েছেন অনেক বেশী।
অনেকে তাদের নিজেদের পেট বা
সংসার চালানোর অর্থ নিয়েছেন দলীয়
কর্মীদের দান-খয়রাতের অর্থ থেকে।
আল্লাহর কাছে দুটি বিষয়ের হিসাব হয়।
একটি হলো তার ঈমান, অপরটি হলো সৎ
আমল। এই দু’টি গুণের কারণেই ঈমানদার
আল্লাহর দরবারে পুরস্কৃত হয়। পবিত্র
কোরআনে মহান আল্লাহপাক বলেছেন,
“ইন্নাল্লাযীনা আমানু ওয়া আমিলুস
সালেহাত, কানাত লাহুম জান্নাতুল
ফিরদাউসি নুযুলা।” অর্থঃ নিশ্চয়ই যারা
ঈমান আনলো এবং নেক আমল করলো
তাদের জন্য আবাসস্থল হল জান্নাতুল
ফেরদৌস। -(সুরা কাহফ, আয়াত ১০৭)
ঈমানদারের কাজ তাই, ঈমানে ও সে
সাথে নেক আমলের সামর্থে লাগাতর
প্রবৃদ্ধি আনা। অন্য কোন যোগ্যতার আগে
একজন ব্যক্তির প্রকৃত যোগ্যতা যাচাই হয়
মূল এ ক্ষেত্র দু’টিতে। ব্যক্তির বড় নেক
আমল হলো, হালাল রুজী অর্জনের মাধ্যমে
নিজের ও নিজ পরিবারের ভরণ-পোষনের
সামর্থ। সে সাথে অন্যের উপকারের
সামর্থ। অথচ খয়রাতের উপর নির্ভরতা সে
সামর্থই হরন করে নেয়। ঈমানদারগণ
শিক্ষক হন, ডাক্তার হন, ব্যবসায়ী বা কৃষক
হন তো সে আমলের সামর্থ বাড়াতেই।
পেশাগত জ্ঞানার্জনও তাই ফরয। এমন
জ্ঞানার্জনের তাগিদে প্রাথমিক
কালের মুসলমানগণ এমনকি গ্রীক বা
অন্যভাষী কাফেরদের লেখা বইও
জায়নামাজে বসে পড়েছেন। এমন
পেশাদারি জ্ঞান না থাকলে যেটি
বাড়ে সেটি পরনির্ভরতা। তখন নিজের ও
নিজ পরিবারের পেট চালাতেও তাদের
নির্ভর করতে হয় কর্মীদের দেয়া সাদকা
বা দান-খয়রাতের উপর। বাংলাদেশের
কোন কোন ইসলামে দলে একারণেই বেড়ে
উঠেছে প্রচুর পরজীবী নেতা-কর্মী। এবং
বেড়েছে তাদের কায়েমী স্বার্থ। এতে
মারা পড়েছে সমাজ বিপ্লবের প্রেরণা।
তারা আর কি নেতৃত্ব দিবেন? তাদের বরং
দীবারাত্র ব্যস্ত থাকতে হয় দলের উপর
প্রতিষ্ঠিত নিজেদের কায়েমীস্বার্থের
পাহারাদারিতে। কর্মীদের ব্যস্ত থাকতে
হয় ইয়ানত বা সাদকা সংগ্রহে। নীচের
তলার নেতা-কর্মীদের মধ্যে তখন গড়ে
উঠে তোষামোদী চরিত্র। কথা হলো, এরূপ
বেতনভোগী নেতাকর্মীদের দিয়ে কঠোর
আমলাতন্ত্র গড়ে তোলা যায়, সংগঠনকেও
দীর্ঘায়ু দেয়া যায়, কিন্তু তা দিয়ে কি
আন্দালনও গড়া যায়? বরং এমন পরজীবী
নেতাদের তখন এজেন্ডা হয়, ভিক্ষার ঝুলি
নিয়ে দুর্বৃত্ত ধণি বা রাজা-বাদাশাহর
দরবারে ধর্ণা দেওয়া।
.
আন্দোলন গড়তে হলে মেরুদন্ডধারি ও
আত্মমর্যাদাবান নেতা দরকার। সেটি কি
বেতনভোগী আমলাদের দিয়ে হয়? কোন
ব্যক্তিকে তারা উপার্জনের পেশা থেকে
উঠিয়ে এনে পরনির্ভর ও পঙ্গু করা যায়,
কিন্তু নেতা বানানো যায় না। বরং এরূপ
ছিন্নমূল করাতে যেটি বেড়ে উঠে সেটি
হলো মোসাহেবী বা চাটুকরি চরিত্র।
যারা প্রকৃত নেতা তারা নিজ নিজ
পেশায় থেকেও বিশাল বিশাল
আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়। এমনই এক নেতা
ছিলেন কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী
জিন্নাহ। তিনি ছিলেন সে আমলে
ভারতের এক বিখ্যাত ও ব্যস্ততম
ব্যারিস্টার। কিন্তু তিনি নেতৃত্ব
দিয়েছেন ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম
ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আন্দোলনের। তার
সে নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল বিশ্বের
সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান। সেদিন
তিনি যে কাজটি করেছিলেন তা ছিল
বিস্ময়কর। বাঙ্গালী, পাঞ্জাবী, পাঠান,
বেলুচ, বিহারী, অসমী, সিন্ধি এরূপ নানা
ভাষাভাষী বিভক্ত মুসলমানদেরকেই শুধু
একত্রিত করেননি, একতাবদ্ধ করেছিলেন
সূন্নী-শিয়া, দেওবন্দি, বেরেলভী, আহলে
হাদীস- এরূপ নানা ফেরকায় বিভক্তদেরও।
অথচ এতবড় বিশাল কাজ করতে গিয়ে
তিনি তার আইনপেশা ছাড়েননি। আরেক
উদাহরণ হলো হযরত ইমাম আবু হানিফা
(রহঃ)। তিনি তাঁর বিশাল ফেকাহগত কাজ
চালিয়েছেন নিজের কাপড়ের ব্যবসার
পাশাপাশি। চাষাবাদ, ব্যবসাবাণিজ্য,
পশুপালনের ন্যায় নানা পেশায় ব্যস্ত
থেকেছেন উচ্চদায়িত্বশীল পর্যায়ের
সাহাবায়ে কেরামও। নিজেদের উপর্জন
থেকে তারা শত শত উট, ভেড়া এবং অর্থ
আল্লাহর রাস্তায় দান করেছেন। অথচ
পেশাগত কোন কাজকর্ম বা ব্যবসা-
বাণিজ্য নেই ইসলামী আন্দোলনের শত শত
নেতা-কর্মীদের। বেতনভূগী এসব
সার্বক্ষণিক নেতাদের হাতে বিস্তর সময়,
অথচ দেশে তারা কোন আন্দোলনই গড়ে
তুলতে পারেনি। একখানি মানসম্মত বই
লেখা দূরে থাক, তাদের জন্য কঠিন হয়ে
পড়ে পত্রিকায় ক্ষুদ্রাকারের প্রবন্ধ
লেখাও। ইসলামী আন্দোলনের আরেকটি
বিশাল ক্ষতি করেছেন তারা অন্য ভাবে।
সেটি হলো, ক্যাডার পদ্ধতির মাধ্যমে
নিজ দলে যোগ্যবান প্রতিদ্বন্দী
নেতাকর্মীদের প্রবেশের বিরুদ্ধে কঠোর
পাহারাদারির ব্যবস্থা করেছেন। অথচ
কোন সমাজ বিপ্লবই নিছক ক্যাডারদের
দিয়ে গড়ে উঠে না। খরস্রোতা নদীর
সৃষ্টিতে যেমন হাজার হাজার
ঝর্ণাধারার মিলন ঘটাতে হয়, তেমনি
আন্দোলন গড়তে হলেও নানা মতের ও
নানা গুণের মানুষের জন্য সংগঠনে স্থান
করে দিতে হয়। এজন্য সংগঠনের চাই
বিশাল ধারনক্ষমতা। কিন্তু সে
ধারনক্ষমতা বাংলাদেশের কোন ইসলামি
সংগঠেনর কি আছে? কোন স্বনামধন্য
প্রফেসর, কোন জেনারেল, বড়মাপের কোন
লেখক বা বুদ্ধিজীবী, কোন বিজ্ঞানী বা
সুপ্রিম কোর্টের কোন বিপারপতিকে
ধারণ করার ক্ষমতা কি এসব দলের আছে?
একই ধরণের খেলোয়াড় দিয়ে একটি ফুটবল
টিমও গড়া যায় না। তাই অভিন্ন গুনের
ক্যাডার দিয়ে সংগঠন গড়া গেলেও
তাদের দিয়ে আন্দোলন গড়া যায় না।
সমাজ বিপ্লবও সৃষ্টি হয় না।
.
বাংলাদেশে ইসলামী দলের সংখ্যা
বাড়াতে বেড়েছে নিজ নিজ দলের
মার্কেটিংয়ের স্পিরিট। বহু হাজার নবী-
রাসূল একত্রে মর্তে নেমে এলেও তাদের
মাঝে কোন বিরোধ সৃষ্টি হতো না। কারণ,
তাদের কাছে যেটি গুরুত্ব পেত সেটি
কোন দলের বিজয় নয়, ইসলামের বিজয়।
তারা নিজের বা দলের প্রোগ্রাম নিয়ে
ময়দানে নামতো না। বরং গুরুত্ব পেত
নিছক আল্লাহকে খুশি করার বিষয়টি।
কিন্তু দলীয় স্বার্থসিদ্ধির চেতনায়
বিলুপ্ত হয় ঐক্যের প্রতি আগ্রহ। তখন সকল
অঙ্গিকার হয় দল ও দলের নেতার প্রতি।
বাংলাদেশে ইসলামপন্থি দলগুলোর মাঝে
একতা এজন্যই অসম্ভব। এসব দলের
নেতাকর্মীরা খেলার মাঠে, ভোজের
টেবিলে বা সিনেমা হলে অন্যদলের বা
অন্যধর্মের ইসলাম বিরোধী সেকুলার
লোকদের সাথে একত্রে বসতে রাজী।
কিন্তু রাজী নয় ইসলামের বিজয়ের
লক্ষ্যে অন্যদলের ঈমানদার ভাইয়ের
সাথে রাজপথে নামতে। এরূপ অবস্থা শুধু
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ
নয়,পীরগণও একই রোগ আক্রান্ত। এটি এক
ভয়ানক অবস্থা। প্রতিটি ইসলামি সংগঠনই
নিজ দলের অনুসৃত ইসলামকে সঠিক ইসলাম
রূপে দাবী করে। অথচ কোনটি সঠিক আর
কোনটি বেঠিক সেটি যাচাইয়ের উপায়
তাদের মুখের কথা নয়, বরং আল্লাহর
রাসূল (সাঃ) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের
অনুসৃত পথের সাথে তাদের চলার পথগুলো
কতটা মিল রাখে সেটির হিসাব নেওয়া।
কথা হলো, সে বিচারে অমিলগুলো কি
কম? নিয়মিত নামায-রোযা পালন করে
তাদের সংখ্যা বাংলাদেশে বহু লক্ষ। বহু
লক্ষ মানুষ ইসলামি দলের পতাকা তলে
জমাও হয়। দেশটিতে প্রতি বছর বিশ
লাখেরও বেশী মানুষ জমা হয় তাবলিগ
জামায়াতের ইজতামায়। কিন্তু প্রশ্ন
হলো, এত নামাযী, এত রোযাদার এবং এত
কর্মী থাকা সত্ত্বেও ক’জনের জীবনে
জ্বিহাদ আছে? ক’জন আল্লাহর দ্বীনকে
বিজয়ী করতে অস্ত্র হাতে ময়দানে
নেমেছে? ক’জন আহত বা নিহত হয়েছে?
বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমান
হওয়া সত্ত্বেও দেশটির রাজনীতি ও
প্রশাসন দখলে গেছে ইসলামের বিপক্ষ
শক্তির হাতে। আদালতে প্রতিষ্ঠিত
কুফরি আইন। কিন্তু তাতে ক’জনের মাতম?
ক’জনের মধ্যে আছে আল্লাহর দ্বীনকে
বিজয়ী দেখার সাধ? ক’জনের মাঝে আছে
সে লক্ষ্যে লড়াই এবং সে লড়াইয়ে
কোরবানী পেশের প্রেরণা? অথচ
মসজিদে মসজিদে নামাযের নিয়মিত
আযান হয়। আহ্বান জানানো হয়, ইসলামী
দলে যোগ দিতে। কিন্তু আল্লাহর দ্বীনকে
বিজয়ী করার কাজেও কি কোন আহ্বান
আছে? দলীয় বা ফেরকাগত বইপত্রের প্রচুর
প্রচার বাড়লেও দেশে কোরআনের জ্ঞান
বিতরণের আয়োজনই কতটুকু? অথচ একাজে
দায়বদ্ধতা তো প্রতিটি ঈমানদারের। সে
দায়ীত্ব পালনে অবহেলা কি কম
অপরাধের?
.
জমিনের বুকে আল্লাহর ঘর বা
ইন্সটিটিউশন হলো মসজিদ। তাই মসজিদের
মালিকানা কোন মসজিদ কমিটির নয়,
ইমাম সাহেবেরও নয়। বরং একমাত্র মহান
আল্লাহর। ফলে মসজিদের কাজ শুধু
নামাযের আয়োজন করা নয়, মসজিদ
কমিটির উদ্দেশ্য পূরণও নয়, বরং মহান
আল্লাহর লক্ষ্য বা অভিপ্রায় পুরণে
সর্বসময় ও সর্বতোভাবে কাজ করা। প্রশ্ন
হলো, আল্লাহর সে মহান অভিপ্রায়টিই
কি? সেটি হলো আল্লাহর দ্বীনের
পরিপূর্ণ বিজয়। পবিত্র কোরআনে
একাধিক বার বর্ণীত হয়েছে সেটি। বলা
হয়েছে, “তিনিই সেই মহান সত্ত্বা যিনি
সত্যদ্বীনসহ রাসূল পাঠিয়েছেন যেন তার
দ্বীন সকল ধর্মের উপর বিজয়ী হতে
পারে।” (সুরা সাফ, আয়াত ৯)
.
আল্লাহতায়ালা তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির
মহাকল্যাণ চান। সেটি যেমন আখেরাতে,
তেমনি দুনিয়ার জীবনেও। সে জন্যই
মানুষকে সঠিক পথ দেখানোর গুরু
দায়িত্বটি নিজের কাছে রেখেছেন।
বলেছেন,”ইন্না আলায়নাল হুদা।” অর্থঃ পথ
দেখানোর দায়িত্ব অবশ্যই আমার। কারণ
মানুষ যত প্রতিভাবানই হোক না কেন
তাদের দ্বারা সেটি সম্ভব নয়। তিনিই
জীবন-পথে সঠিক পথচলার জন্য রোডম্যাপ
দিয়েছেন। পবিত্র কোরআন হলো সে
রোডম্যাপ। ভূ-পৃষ্ঠের প্রকৃত কল্যাণ তো
আসে তাঁর কোরআনী হুকুমগুলোর পরিপূর্ণ
প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। আর সেগুলোর
প্রতিষ্ঠার কথা উঠলে কাফেরদের পক্ষ
থেকে প্রচন্ড বিরোধীতাও আসে। তখন
অনিবার্য হয়ে উঠে সংঘাত। মোমেনে
জীবনে এভাবেই তো অনিবার্য হয়ে উঠে
জ্বিহাদ। এবং এপথেই রাষ্ট্র থেকে
নির্মূল হয় মিথ্যাচারিরা। আর জ্বিহাদের
এ পথ বেয়েই মোমেন পৌছে জান্নাতে। এ
প্রসঙ্গে মহান আল্লাহতায়ালার
ঘোষণাটি হলোঃ “হে ঈমানদারগণ, আমি
কি তোমাদেরকে এমন এক ব্যবসার কথা
বলে দিব যা তোমাদেরকে কঠিন আযাব
থেকে মুক্তি দিবে? আর সেটি হলো
তোমরা আল্লাহ ও তার রাসূলের উপর
ঈমান আনো এবং আল্লাহর রাস্তায়
জানমাল দিয়ে জ্বিহাদ করো। আর এটিই
তোমাদের জন্য কল্যাণকর যদি সেটি
তোমরা জানতে।” (সুরা সাফ আয়াত ১-১১)
.
তাই আর সেটি কি শুধু এই, মুসলমানগণ
সেখানে নিছক নামায পড়বে বা সেখানে
বসে কোরআন পড়েবে। বরং বিজয়ের জন্য
যা কিছু আবশ্যক সে সবের ব্যবস্থা করা।
জনগণকে দায়িত্ব সচেতন এবং সে সাথে
তাদেরকে উজ্জিবীত করা। নবীজী
(সাঃ)র আমলে মুসলমানদের কোন
ক্যান্টনমেন্ট বা সেনাদফতর ছিল না।
মসজিদ থেকেই সংগঠিত হয়েছিল
জ্বিহাদ। বাংলাদেশের রাষ্ট্র না হ্য়
ইসলামের বিপক্ষ শক্তির দখলে, কিন্তু
মসজিদগুলি তো আলেমদের দখলে।
সেখানে আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ের
লক্ষ্যে প্রস্তুতি কই? নবীজী (সাঃ)এর
যুগে মসজিদ তাই শুধু নামাযীই পয়দা
করেনি, মোজাহিদ এবং শহীদও পয়দা
করে। বাংলাদেশে বহু লক্ষ মসজিদ, কিন্তু
তা থেকে ক’জন মোজাহিদ বা শহীদ পয়দা
হয়েছে? জ্বিহাদ সংগঠিত করা দূরের
কথা, মসজিদের মুসল্লীদের পক্ষ থেকে
আল্লাহর আইনের প্রতিষ্ঠার আওয়াজও
কি উঠেছে? চিনিকলের কাজ হলো চিনি
উৎপাদন করা। কিন্তু তা থেকে সেটির
উৎপাদনই যদি না হয় তবে সেটি যে বিকল
তা নিয়ে কি সন্দেহ থাকে? আর যে
সমাজে ইসলামকে বিজয়ী করার
প্রচেষ্টা নেই সে সমাজে মুসলমানগণ
সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও ইসলাম যে পরাজিত
হবে সেটিই তো স্বাভাবিক।
.
ঈমানী দায়বদ্ধতার সাথে গাদ্দারি
মুসলমান হওয়ার দায়বদ্ধতা শুধু এ নয় যে,
মহান আল্লাহতায়ালাকে তার
সর্বশক্তিময় মাবুদ রূপে মেনে নিবে এবং
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে তার সর্বশেষ
রাসূল স্বীকৃতি দিবে। বরং বড় দায়বদ্ধতা
হল, আল্লাহর প্রতিটি হুকুম মেনে চলার
এবং তার প্রতিটি হুকুমের অবাধ্যতা
থেকে বাঁচার। আল্লাহর কোন বিধান যদি
না জানার কারণে পালিত না হয়ে থাকে
তবে সেটিও বড় অবাধ্যতা। সে
অবাধ্যতাটি জ্ঞানার্জনের প্রতি
আল্লাহর যে সুস্পষ্ট হুকুম সেটি অমান্যের।
কোরআন-হাদীসের জ্ঞানার্জন শুধু
মাওলানা-মৌলভী সাহেবদের উপর ফরয
নয়, ফরয প্রতিটি ব্যক্তির উপরও।
জ্ঞানার্জনের সাথে রাষ্ট্র জুড়ে সে
জ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতেও নামতে হয়। তাই
নামাযের আযান শুনে শুধু মসজিদে ছুটলে
ও রমযান মাসে রোযা রাখলেই দায়ীত্ব
পালন হয়না। ইসলামী আইনের
প্রতিষ্ঠাতেও দায়বদ্ধ হতে হয়। দায়বদ্ধ
হতে হয় মুসলমানদের ঐক্য গড়াতেও।
আল্লাহর পক্ষ থেকে আযাব শুধু এ জন্য
আসে না যে, নামায-রোযা পালনে মানুষ
অনাগ্রহী বা আল্লাহকে তারা মাবুদ রূপে
স্বীকার করেনা। বরং মুসলমানদের ঐক্যে
অনাগ্রহী ও তাদের মাঝে বিভক্তি
গড়লেও আল্লাহতায়ালার ভয়ানক আযাব
অনিবার্য হয়ে উঠে। কোরআনে বলা
হয়েছে, “ওয়া তাসিমু বিহাবলিল্লাহি
জামিয়াঁও ওলা তাফারাক্কু” (সুরা আল-
ইমরান আয়াত-১০৩) অর্থঃ এবং তোমরা
আল্লাহর রশিকে সম্মিলিত ভাবে আঁকড়ে
ধর এবং পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়োনা। তাই
ইসলামে শুধু মুর্তিপুজা, মদ-জুয়া, সূদ-ঘুষই
হারাম নয়, বিভক্তি ও বিচ্ছিন্নতাবাদও
হারাম। একাজ একমাত্র কাফের বা
মুনাফিকদের, কোন ঈমানদারের নয়। সুরা
ইমরানের ১০৫ আয়াতে এমন অবাধ্যতার
পরিণতি শোনানো হয়েছে এভাবে,
“ওয়ালাতাকুনু কাল্লাযীনা তাফাররাকু
ওয়াখতালাফু মিম বা’দি মা’জাআ হুমুল
বাইয়ানাহ, ওয়া উলায়িকা লাহুম আযাবুন
আযীম”। অর্থঃ এবং তোমরা তাদের মত
হয়োনা যারা সুস্পষ্ট ঘোষণা আসার পরও
বিভক্তি গড়লো এবং বিরোধীতা করলো।
এবং তাদের জন্য হলো কঠিন আযাব।
তাই আল্লাহর পক্ষ থেকে ভয়ানক আযাব
প্রাপ্তির জন্য মুর্তিপুজারি হওয়ার
প্রয়োজন পড়েনা। এজন্য মদ-ঘুষ বা শুকরের
মাংস খাওয়াও জুরুরী নয়। নিছক পরস্পরের
বিভক্তি ও বিরোধীতাই সেজন্য যথেষ্ট।
বনি ইসরাইলের লোকেরা যে মহান
আল্লাহকে অস্বীকার করতো তা নয়।
তারা হযরত মুসা (আঃ) ও হযরত হারুন
(আঃ)কে আল্লাহর নবী রূপে স্বীকার
করতো। তারা তাওরাতও পাঠ করতো।
তাদের অপরাধ, তারা সমাজে বিভক্তি ও
বিরোধ সৃষ্টি করতো। ফলে তাদের উপর
ভয়ানক আযাব নেমে এসেছিল। অপর
দিকে আল্লাহতায়ালার কাছে অতিশয়
প্রিয় হল তাঁরা যারা দ্বীনের প্রতিষ্ঠায়
ঐক্যবদ্ধ। পবিত্র কোরআন এ বিষয়ে
ঘোষণাটি এসেছে এভাবেঃ ইন্নাল্লাহা
ইউহিব্বুল্লাযীনা ইউকাতিলুনা ফি
সাবিলিহি সাফ্ফান কা’আন্নহুম বুনিয়ানুন
মারসুস। অর্থঃ নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা
তাদেরকে ভালবাসেন যারা তার রাস্তায়
সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ
ভাবে যুদ্ধ করে। -(সুরা সাফ আয়াত-৪)
.
নামাযের আযান শোনা মাত্রই ঈমানদার
ব্যক্তি মসজিদে ছুটে, মসজিদের যাওয়ার
সামর্থ না থাকলে ঘরে বা কর্মস্থলে
নামায আদায় করে। ঈমানের প্রকাশ তো
এভাবেই ঘটে, নইলে ঈমান নিয়ে সন্দেহ
জাগাই স্বাভাবিক। বিষয়টি একতা
প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও। ঈমানদার মাত্রই
সচেষ্ট হবে তার মুসলমান ভাইদের সাথে
একতা গড়ায়। সে তখন তার মুসলমান
ভাইয়ের গায়ের রং দেখে না। দেখে না
তার মুখের ভাষা, পোষাকপরিচ্ছদ, জাত-
পাত ও পেশা। মুসলমান ভাইয়ের ঈমানী
পরিচয়টিই তার কাছে মূল। দল বা সংগঠন
মানুষ নানা মতলবে করে। পশুও দলবদ্ধ
ভাবে চলে। কিন্তু যে ব্যক্তি একনিষ্ঠ
ভাবে একটি দল বা জামায়াতে শামিল
হলো অথচ তার মধ্যে মুসলিম উম্মাহর
বিভক্ত অবস্থা দেখে মাতম সৃষ্টি হলো
না, এবং সৃষ্টি হলো না একতাবদ্ধ করার
প্রেরণা -তাকে কি প্রকৃত ঈমানদার বলা
যায়? অথচ বাংলাদেশের ইসলামপন্থিদের
পচন এ পর্যায়ে পৌছেছে যে তারা আজ
মুসলিম উম্মাহর বিভেদ ও বিচ্ছেদ দেখে
দুঃখিত হয় না। বরং বিচ্ছেদের
দিনক্ষণকে উৎসবে পরিণত করেছে।
আধুনিক বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র
পাকিস্তানের খন্ডিত হওয়ার ঘটনা নিয়ে
এতকাল শুধু কাফের শক্তি ও তাদের
বাংলাদেশী মিত্ররা আনন্দ উৎসব করতো।
এখন সে উৎসবে বাংলাদেশের প্রধান
ইসলামী দলও শামিল হচ্ছে।
বাংলাদেশে মসজিদগুলো উপচে পড়ছে
নামাযীতে। গড়ে উঠেছে ইসলামের নামে
বহু সংগঠন। কিন্তু যেটি গড়ে উঠেনি
সেটি ঐক্য। বরং সংগঠনগুলোর কাজ হয়ে
দাঁড়িয়েছে নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচাতে
বিভক্তির কারণগুলোকে আরো বড় করে
বাঁচিয়ে রাখা। কারণ এমন বিভক্তির
মধ্যেই নির্ভর করে তাদের নিজেদের
বাঁচাটি। মুসলিম উম্মাহর ঐক্যকে তারা
নিজেদের জন্য মৃত্যু পরওয়ানা মনে করে।
তারা জানে, অনৈক্যের কারণে উম্মাহর
যত অকল্যাণই হোক, এ অনৈক্যই তাদের
রাজনৈতিক অস্তিত্ব দিয়েছে। নইলে
উম্মাহর মাঝে তারা বিলুপ্ত হয়ে যেত।
এখন তাদের উৎসাহ, দলীয় স্বার্থে এ
বিভক্তিকে টিকিয়ে রাখা। এমন দলীয়
চেতনার কারণে সত্তরের নির্বাচনে
ইসলামি দলগুলি একতাবদ্ধ হতে পারেনি।
যাদের এক আসনে জেতার সামর্থ ছিল না,
তারা প্রার্থী দিয়েছিল শতাধিক
আসনে। অথচ পাকিস্তানের জীবনে সেটি
ছিল অতি সংকটকাল। সেদিন জোটবদ্ধ
হয়েছিল ইসলামের সকল বিপক্ষ শক্তি।
সত্তরের দশকের শেষার্ধে একতার লক্ষ্যে
যখন বাংলাদেশের কয়েকটি ইসলামী দল
মিলে একটি দলে পরিণত হলো সে দলটিও
বেশী দিন বাঁচেনি। বিভক্তি গড়ার
প্রেরণা যখন প্রবল, তখন একতার প্রয়াস
কি আয়ু পায়? দলীয় স্বার্থে ইসলামী
দলের নেতারা সেকুলার নেতাদের সাথে
জোট গড়তেও রাজী। আল্লাহর হুকুমের
বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহের ঝান্ডা উড়িয়ে
চলে তাদের সাথে রাজপথে নামতে বা
তাদের মন জুগাতে নগ্নপদে স্মৃতীস্তম্ভে
ফুল চড়াতে যেতেও প্রস্তুত। কিন্তু রাজী
নয় দেশের অন্যান্য ইসলামপন্থিদের সাথে
একতা গড়তে। ফলে বাংলাদেশের হিন্দু-
খৃষ্টান-বৌদ্ধরা বা ইসলামের বিপক্ষ
দলগুলি একই মঞ্চে একতাবদ্ধ হলেও
ইসলামপন্থিদের পক্ষে সেটি অসম্ভব।
অনেকটা অকল্পনীয়ও। মহান
আল্লাহতায়ালা কি তার নিজ বাহিনীর
মাঝে এমন বিভক্তি দেখে খুশি হতে
পারেন? এমন বিভক্তির পর ইসলামি
দলগুলো কি পারে মহান আল্লাহর করুণা
পেতে?
.
যে কোন জনগোষ্ঠীর মাঝে মতভেদ তো
থাকবেই। কিন্তু সে মতভেদকে ভিত্তি
করে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভক্তি গড়া
তো কবিরা গুনাহ। অথচ বাংলাদেশে এ
গুনাহটিই ব্যাপকভাবে হচ্ছে। এটি সুরা
আল ইমরানে ঘোষিত ১০৩ নম্বর আয়াতের
চরম অবাধ্যতা। অথচ সে অবাধ্যতার
পতাকা উড়িয়ে চলছে তথাকথিত ইসলামী
দলের নেতাগণ। এমন অবাধ্যতা আল্লাহর
আযাব ডেকে আনে। বাংলাদেশের
ইসলামপন্থিদের যেরূপ লাগাতর পরাজয় ও
নিগৃহীত দুরাবস্থা – সেটি কি আল্লাহর
পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কোন রহমতের
আলামত? ঈমানদার হওয়ার শর্ত হলো, অন্য
মুসলমান ভাইয়ের অভিমত পছন্দ না হলেও
তার সাথে একত্রে চলার সামর্থ অর্জন।
হযরত আলী (রাঃ)এর সাথে হযরত উমর
(রাঃ) মতের অমিল পূর্ব থেকেই ছিল।
কিন্তু সে অমিলগুলো নিয়ে রাজনীতি শুরু
হলে খোলাফায়ে রাশেদা আরো অনেক
আগেই বিলুপ্ত হত। ইসলামের প্রাথমিক
কালে মাত্র শত বছরের মাঝে
মুসলমানেরা বাংলাদেশের চেয়ে শতগুণ
বৃহৎ রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল। সে
রাষ্ট্রের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে
যেতে ৬ মাস লেগে যেত। তারপরও
সেটিকে তারা টুকরো টুকরো করেনি।
যারা এ রাষ্ট্রটির জন্ম দিয়েছিলেন
তারা সংখ্যায় বাংলাদেশের একটি
জেলার জনসংখ্যার সমানও ছিল না। অথচ
মুষ্টিমেয় জনগণের একতার বলে সেদিনের
মুসলমানেরা পরিণত হয়েছিল
বিশ্বশক্তিতে। অনৈক্যের কারণে যে
শক্তিক্ষয় হয় তা কি সম্পদ দিয়ে পূরণ হয়?
নবীজী যে অখন্ড রাষ্ট্র রেখে
গিয়েছিলেন সেটিকে তারা হাজার বছর
টিকিয়ে রেখেছেন এবং ক্রমাগত তার
বিস্তার ঘটিয়েছেন। এমন এক বিশাল
ভূগোলের কারণেই সেকালের মুসলমানরা
বিশ্বশক্তি রূপে বিশ্বব্যাপী সম্মান
পেয়েছে। অথচ যখন বিভক্তি এল তখন সে
সাথে অপমান, পরাজয় ও গ্লানিও এল।
মুসলিম জনপদে নেমে আসলো হত্যা, ধর্ষণ
ও আগ্রাসন। আর আজকের মুসলমানেরা
সেটিরই ঘানি অবিরাম টানছে।
.
তাবলিগ জামায়াতের আবিস্কার
বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের মত
দেশগুলিতে নবীজী(সাঃ)র প্রচারিত ও
প্রতিষ্ঠিত ইসলামকে আড়াল করার
ক্ষেত্রে সবচেয়ে ব্যাপক ও সফল ভাবে
কাজ করছে তাবলিগ জামায়াত। এদের
প্রভাবে লক্ষ লক্ষ মুসলমানের পক্ষে আল-
কোরআনে বর্ণিত ইসলামের সঠিক পরিচয়
লাভ অসম্ভব। তাবলিগ জামায়াতে
আজাবীন কাটালেও সনাত ইসলামের
সাথে পরিচয় ঘটবে -সে সম্ভাবনা কম।
তাবলিগী ব্যক্তি ইসলাম সম্মদ্ধে যেটুকু
বুঝবে তা হলো নিয়মিত নামায-রোযা
আদায়, নামাযের জন্য মানুষকে মসজিদে
ডাকা, কিছু দানখয়রাত করা, মাঝে মধ্যে
ঘর-সংসার ছেড়ে ছিল্লাহতে বের হওয়া,
এবং প্রতিবছর তথাকথিত বিশ্ব-ইজতেমায়
যোগ দেওয়া। সমাজ, শিক্ষা, রাজনীতি ও
আইন-আদালতেরর ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র
ইসলামের প্রতিষ্ঠা এবং দ্বীনের
প্রতিষ্ঠায় জ্বিহাদে অংশ নেওয়া যে
ফরয ইবাদত সে ধারণাটুকু তাবলিগী
ব্যক্তি পায়না। ইসলামের এমন প্রতিষ্ঠা
ও বিজয় আনতে গিয়ে সাহাবায়ে
কেরামদের যে জানমালের সবচেয়ে বড়
কোরবানীটি পেশ করতে হয়েছে, শতকরা
৬০ ভাগের বেশী সাহাবী যে একাজে
শহিদ হয়েছেন -সে খবরও সে পায় না।
কারণ তাবলিগ জামায়াতের বই
“ফাজায়েলে আমল” এ সে কথা নেই।
তাদের ইজতেমা বা চিল্লাহতেও সে কথা
বলা হয় না।। তাবলিগী ব্যক্তিটি এমন কি
সমাজ কল্যাণে অংশ নেওয়ার ধারণাটিও
পায় না । প্রলয়ংকরি দুর্যোগে বিপন্ন
মানুষের ঘরবাড়ি মেরামত করে দেওয়া,
তাদের খাদ্য, বস্ত্র ও চিকিৎসার
প্রয়োজন মেটানোও যে ইবাদত সে ধারণা
তার সামান্যই। বাংলাদেশে দুর্যোগ তো
ফি বছর। তাবলিগ জামায়াতের বহু লক্ষ
লোক প্রতি বছর দেশে-বিদেশে চিল্লাহ
দিতে বের হয়। কিন্তু দুর্যোগগ্রস্ত বিপন্ন
মানুষের দোয়ারে সাহায্য নিযেও কি
তারা হাজির হয়?
.
প্রশ্ন হলো,বাংলাদেশের সব মানুষ যদি তাবলিগী
হয়ে যায় তাতেই বা কতটুকু লাভ হবে?
তারা কি দেশে শরিয়ত প্রতিষ্ঠা করবে?
আনবে কি ইসলামের বিজয়? সেটি তো
তাদের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যই নয়। সে কথা
তো তারা মুখেই আনে না? দেশের উপর
কাফের শক্তির হামলা হলেও কি তারা
জ্বিহাদের নামবে? তাদের সংখ্যা
বৃদ্ধিতে বরং বড় জোর যেটি হতে পারে
তা হলো, বিশ-ত্রিশ লাখের বদলে বিশ্ব-
ইজতেমায় ৫০ লাখ বা এক কোটি মানুষ
জমা হবে। আখেরাত মোনাজাত শেষে সে
মানুষগুলো আবার ঘরে ফিরে যাবে।
সেকুলার সমাজ ও রাজনীতির নানা ঝাঁক
থেকে আসা ঝাঁকের এই কইগুলো আবার
নিজ নিজ ঝাঁকে মিশে যাবে।
বাংলাদেশের নানা রাজনৈতিক ও
সামাজিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা তো
এভাবেই প্রতি বছর টঙ্গিতে আখেরী
মোনাজাতে যোগ দেয়, এবং মোনাজাত
শেষে নিজ নিজ দলীয় মিশন নিয়ে পূর্ববৎ
কাজে নেমে যায়। তাবলিগী জামায়াতে
আসার কারণে তাদের বাঁচবার মিশনে,
রোডম্যাপে বা রাজনীতিতে আদৌ কি
কোন পরিবর্তন আসে? আসছে কি দেশের
রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে কোন পরিবর্তন।
বরং হচ্ছে তো উল্টো। দেশে যতই বাড়ছে
তাবলিগী মানুষ এবং বিশ্ব-ইজতেমায়
লোকের সংখ্যা, দেশ ততই ডুবছে
দূর্নীতিতে।
.
তাবলিগ জামাতের ন্যায় এই বিশাল
জামায়াতটি তাদের সকল সামর্থ
বিণিয়োগ করছে মানুষকে শুধু নামাযের
দিকে ডাকতে, পূর্ণ ইসলামের দিকে নয়।
অথচ কোরআন বলছে মানুষকে আল্লাহর
রাস্তায় ডাকতে ( উদয়ু ইলা সাবিলি
রাব্বিকা), বলছে পরিপূর্ণ ইসলামে
দাখিল হতে (উদখুলু ফিসসিলমি কা’ফ্ফা)।
শুধু নামাজে বা বিশ্বইজতেমায় ডাকলে
কি মহান আল্লাহর সে হুকুম পালিত হয়?
আল্লাহর রাস্তাটি হলো সিরাতুল
মোস্তাকিম। এ পথে যেমন নামায-রোযা,
হজ্ব-যাকাত আছে, তেমনি জ্বিহাদও
আছে। ইসলামের তাবলিগ বা প্রচার হতে
হবে অমুসলমানদের মাঝে। মুসলমানদের
জন্য যেটি হতে হবে সেটি ইসলাহ, তা’লিম
ও তারবিয়তের ব্যবস্থা। নবীজীর এটিই
সূন্নত তরিকা। অথচ তাবলিগীরা
অমুসলমানদের কাছে ইসলামের দাওয়াত
নিয়ে যায় না। অমুসলমানদের কাছে
ইসলামের পয়গাম নিয়ে যাওয়া যে
মুসলমানদের একটি দায়বদ্ধতা সে হুশও
তাদের নেই। বাংলাদেশে যে লক্ষ লক্ষ
তাবলিগী বহু লক্ষ মানুষের ঘরে দাওয়াত
নিয়ে যায়, তাদের ক’জন অমুসলমানের
কাছে যায়? এটি কি আল্লাহর হুকুম ও
নবীজী (সাঃ)র সুন্নত নয়? অথচ আল্লাহর
সে হুকুম ও নবীজী (সাঃ)এর সে সুন্নত
তাদের কাছে কোন গুরুত্বই পায়নি। তারা
ইসলামের এক নতুন ব্যাখা খাড়া করেছে?
তারা যে চিল্লায় বেরুয় সেটিই বা কোন
সূন্নত? কোরআন বুঝা সাধারণ মানুষের
জন্য তারা অসম্ভব মনে করে। ফলে তাদের
আগ্রহ ফাজায়েলে আমল থেকে শিক্ষা
নেওয়া। কোরআনকে শুধু তেলাওয়াত করে।
অথচ মহান আল্লাহ বলছেন, “যাক্কের বিল
কোরআন” অর্থঃ তোমরা কোরআনের
মাধ্যমে মানুষকে সাবধান করো। আল্লাহর
চেয়ে আর কে মানুষকে উত্তম ভাবে
দাওয়াত দিতে পারে? কোরআনের
বোধগম্যতা নিয়ে স্বয়ং মহান আল্লাহর
নিজের ভাষ্য হলো, এ গ্রন্থটি নাযিল
হয়েছে সহজ ভাষায় যাতে সাধারণ মানুষ
বুঝতে পারে। কোরআন তাই আরবের
নিরক্ষর বেদুঈনরাও বুঝতো এবং সেটি
কোন মাদ্রাসায় বা বিশ্ববিদ্যালয়ে না
গিয়ে। ফলে কোরআনের হুকুমগুলি বুঝতে
বা পালন করতে তাদের কোন অসুবিধা
হয়নি। অথচ আজকের মুসলমানদের সবচেয়ে
বড় ব্যর্থতাটি হলো এক্ষেত্রটিতে। ফলে
মুসলমানেরা অন্যদের আর কি ইসলাম
বুঝাবে, নিজেদের জীবনেই সে বুঝটি
আসেনি। প্রাথমিক কালে ইসলামের দ্রুত
প্রসারের কারণ, তখন মুসলমানরা একমাত্র
কোরআনকেই দ্বীন প্রচারের কাজে
ব্যবহার করতো। তখন এত রাশি রাশি
কেতাব ছিল না। তখন যারা মুসলমান হত
তাদের মধ্যেও জন্ম নিত কোরআন বুঝার
প্রবল আগ্রহ। সে প্রবল আগ্রহে এমন কি
বিলুপ্ত হয়ে গেছে তাদের নিজেদের
মাতৃভাষা। যেমনটি মিশর, ইরাক, সূদান,
আলজিরিয়া, সূদান, মরক্কোর মত বহু দেশে
ঘটেছে। তাবলিগীদের কাছে গুরুত্বহীন ও
অপ্রয়োজীয় মনে হয় ইসলামি রাষ্ট্রের
প্রতিষ্ঠা। ফলে কারো সাথে তাদের
কোন শত্রুতাও নাই। দেশের অতি দুর্বৃত্ত
নেতারাও তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
জ্বিহাদী ইসলামপন্থিদের ন্যায় তারা
এসব দুর্বত্তদের বিরুদ্ধে কোন চ্যালেঞ্জ
খাড়া করে না। বরং তাদের হাতে তারা
রাজনীতি, প্রশাসন, আইন-আদালত ছেড়ে
দেয়। প্রশ্ন হলো, রাজনীতি তথা রাষ্ট্র
পরিবর্তনের উদ্যোগ থেকে হাত গুটিয়ে
শুধু নামাজের দিকে মানুষকে ডাকলে কি
আল্লাহ দ্বীনের বিজয় আসে? এভাবে কি
সমাজে নামাজের ন্যায় ইসলামের কোন
বিধান প্রতিষ্ঠা পায়? আর সেটি হলে
নবীজী (সাঃ) ও সাহাবাদের জীবনে
কেন এত রক্তক্ষয়ী জ্বিহাদের প্রয়োজন
দেখা দিল?
.
যারা দেশে সমাজ বিপ্লব বা রাষ্ট্র
বিপ্লব চায় তাদের একটি মৌলিক বিষয়
বোঝা উচিত। সেটি হলো রাষ্ট্র এবং
রাষ্ট্রের অপ্রতিরধ্য শক্তি নিয়ে ধারণা।
রাষ্ট্রীয় শক্তিকে দখলে আনতে না
পারলে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে
ইসলামের প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। ইসলামের
বেশীর ভাগ আহকাম তখন কেতাবেই
থেকে যায়। অথচ ইসলামের কোন বিধানই
শুধু কেতাবে থাকার জন্য আসেনি। এজন্যই
আল্লাহর নবী (সাঃ) এর আমলে
সাহাবাদের জানমালের সবচেয়ে বেশী
ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে রাষ্ট্র্রকে দখলে
নিতে। শতকরা ৬০ ভাগের বেশী সাহাবা
একাজে শহীদ হয়েছেন। তখন সেকালে
মুসলমানদের কোন মাদ্রাসা ছিল না। ছিল
না কোন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়। রাষ্ট্র্র
দখলে আসলে তখন সমগ্র দেশই মাদ্রাসায়
পরিণত হয়। খোলাফায়ে রাশেদার আমলে
তাই হয়েছিল। আর আজকের আলেমগণ
ব্যস্ত শুধু মাদ্রাসা ও মসজিদ গড়া নিয়ে।
তারা রাষ্ট্রের দখলদারি ছেড়ে দিয়েছে
ইসলামের বিপক্ষ শক্তির হাতে। অনেক
আলেম তো মসজিদ-মাদ্রাসায় রাজনীতির
আলোচনাকে দুনিয়াদারি মনে করে। এবং
নিজেদের দখলকৃত মাদ্রাসায় সেগুলো
নিষিদ্ধও করে রাখে। নামায-রোযা
পালন, কোরআন পাঠ ও কোরআন শিক্ষার
লক্ষ্যে মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার
অধিকারকেই তারা বড় কিছু মনে মনে
করে। এগুলি প্রতিষ্ঠা এবং সেখানে বড়
বড় জলসা করার অধিকার পেলেই তারা
পুলকিত বোধ করেন। এমন একটি চেতনার
কারণেই দেওবন্দি আলেমদের একটি
বিরাট অংশ এবং প্রখ্যাত দেওবন্দি
আলেম মাওলানা হোসেন আহমেদ
মাদানীর নেতৃত্বাধীন জমিয়তে
উলামায়ে হিন্দ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার
বিরোধীতা করেছিলেন। তবে তাদের এমন
আচরণেরও ঐতিহাসিক কারণ আছে। সেটি
হলো, এসব মাদ্রাসায় কোরআন হাদীসের
চর্চা হলেও সেখানে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা
সমাজ-বিজ্ঞানের পাঠ দেয়া হয়না। ফলে
অজানাই থেকে যায় রাষ্ট্রের অপরিমেয়
শক্তির ধারণা। এবং অজানা থেকে যায়
রাষ্ট্র-বিপ্লব ও সমাজ বিপ্লবের মূল
উপকরণগুলো। দ্বিতীয় কারণটি হলো,
দ্বীনী মাদ্রাসায় যেটি গুরুত্ব পায় সেটি
মুখস্থ্ বিদ্যা। ইসলামী পরিভাষায় যাকে
বলা হয় নকলী ইলম। আকলী ইলম তথা
বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান নয়। ফলে এসব
মাদ্রাসার শিক্ষক বা ছাত্রগণ বহু হাদীস
এক নিশ্বাসে মুখস্থ শুনিয়ে দিতে পারেন,
বহু কবির বয়াতও শুনিয়ে দিতে পারেন।
কিন্তু উম্মাহ যখন বিপদে পড়ে তখন তারা
দিশেহারা হয়ে পড়েন। তখন ব্যর্থ হন
সমাধান দিতে। কারণ এজন্য তো প্রয়োজন
চিন্তা-ভাবনার সামর্থ, মুখস্থ বিদ্যা নয়।
ফলে অধিকাংশ আলেম ১৯৪৭ সালে তাই
কোন সমাধা দিতে পারেননি।
ফসল ফলাতে হলে যেমন উর্বর মাটির মাঠ
দরকার হয়, তেমনি ইসলামের প্রতিষ্ঠা
বাড়াতে হলেও রাষ্ট্র দরকার হয়। নবীজী
(সাঃ) তাই রাষ্ট্র গড়েছেন এবং সে
রাষ্ট্র নিজ দখলে নিয়েছেন। উপরুন্ত সে
রাষ্ট্রকে নিরাপদ ও শক্তিশালী করতে
রোম সাম্রাজ্যের রাজধানি
কন্সট্যান্টিনোপল (ইস্তাম্বুল) দখলেরও
নসিহত করেছেন। কিন্তু এমন এক
স্ট্রাটেজিক ধারণা দেওবন্দি ওলামাদের
ছিল না। ছিল না জামায়াতে ইসলামীর
প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মওদূদীরও।
.
মওলানা মওদূদী একসময় জমিয়তে
উলামায়ে হিন্দের পত্রিকা “জমিয়ত”য়ের
সম্পাদক ছিলেন। ফলে তার উপর জমিয়তে
উলামায়ে হিন্দের প্রভাব পড়া
অস্বাভাবিক ছিল না। তাই তিনি বহু বই
এবং বহু হাজার বাক্য লিখলেও একটি
বাক্যও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠান সমর্থনে
লেখেননি। তবে আলেমদের মাঝে যে
ব্যতিক্রম ছিল না তা নয়। পাকিস্তানে
প্রশ্নে মাওলানা আশরাফ আলী থানবী
(রহঃ) এবং মাওলানা শিব্বির আহাম্মদ
উসমানি জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের
বিপরীতে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম
প্রতিষ্ঠা করেন। এবং পাকিস্তান
প্রতিষ্ঠার পক্ষে জনমত গড়ে তুলেন। সে
সময়টি অখন্ড ভারতের মুসলমানদের জন্য
ছিল অতিশয় ক্রান্তিলগ্ন। ইংরেজদের
তখন বিদায়ের বেলা এবং ভারত জুড়ে
তখন উত্থান ঘটছিল মারমুখী সাম্প্রদায়িক
হিন্দু শক্তির। তারা মুসলমানদের জন্য
চাকুরী-বাকুরি ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়
ভাগাভাগীতে কোন ছাড় দিতে রাজী
ছিল না। এর বড় প্রমাণ, অবিভক্ত
বাংলাতে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ
হলেও সরকারি চাকুরিতে তাদের সংখ্যা
শতকরা ৫ ভাগও ছিল না। অথচ অনেক
মুসলমানই সেদিন ভেবেছিলেন, ইংরেজরা
চলে গেলে মুসলমানেরা আবার হারানো
রাজ্য ফিরে পাবে। মসজিদ-মাদ্রাসার
নির্মানে আরো আজাদী মিলবে। আজাদী
মিলবে বড় বড় এজতেমা করার। ফলে এমন
বিভ্রান্ত মুসলমানেরা সেদিন আগ্রহ
পায়নি পাকিস্তান সৃষ্টিতে। নির্বুদ্ধিতা
আর কাকে বল? এ ধরণের মুসলমান ও
তাদের নেতৃত্বাধীন ইসলামী দলগুলোর
এটি কি কম অপরাধ? উপমহাদেশের
মুসলমানদের জন্য বড় সৌভাগ্য হল, সে সময়
তারা পেয়েছিল আল্লামা ইকবালের মত
একজন প্রজ্ঞাবান দার্শনিক ব্যক্তির।
ইংরেজ শাসনের অবসানে পর ভারতের
মুসলমানদের জীবনে কীরূপ দূর্দিন নেমে
আসবে সেটি বড় বড় দেওবন্দি আলেম
বুঝতে না পারলেও তার দূরদৃষ্টিতে সেটি
ধরা পড়েছিল। তখন তিনি পেশ করেন
সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম প্রদেশ নিয়ে
পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার
পরিকল্পনা।
.
১৯৩০ সালে মুসলিম লীগের
এলাহাবাদ সম্মেলনে সভাপতির ভাষনে
তিনি যে দর্শনটি পেশ করেন তা হলো,
ইসলামের ইবাদত ও আধ্যাত্যিক চেতনার
সাথে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত ইসলামের
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। একটির অবর্তমানে
অন্যটি বাঁচেনা, মগজ বা ফুসফুস যেমন
বাঁচেনা হৃদপিন্ডের অবর্তমানে। তার
কথা, মুসলমানের ঈমান, ইবাদত বন্দেগী ও
মুসলমানত্ব বাঁচাতে হলে ইসলামি রাষ্ট্র
গড়া অপরিহার্য। সেদিন যে দর্শনটি
তিনি তুলে ধরেছিলেন তা হলঃ
“The religious ideal of Islam was organically
related to the social and political system.
The rejection of the one will eventually
involve the rejection of the other. Therefore
the construction of a policy on national line,
if it means the displacement of the Islamic
principle of solidarity, is simply unthinkable
to a Muslim.”
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিষয়টি এভাবেই
পায় এক প্রবল দার্শনিক ভিত্তি তথা
কনসেপ্টচুয়াল ফ্রেমওয়ার্ক। সে
পরিকল্পনার পক্ষে সফল উকালতির জন্য
মুসলমানগণ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ন্যায়
একজন সেরা উকিলও পেয়ে যায়।
জিন্নাহর দায়ীত্ব পড়ে ভারতীয়
মুসলমানদের আদালতে এবং সে সাথে
ইংরেজ শাসকদের আদালতে
পাকিস্তানের পক্ষে যুক্তি পেশ করা।
তিনি তাতে সফলও হন। ফলে সৃষ্টি হল
বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র। ফলে
হত্যা-ধর্ষণ থেকে নিরাপত্তা পেল ৩০
কোটির মত মুসলিম নর-নারী (আজকের
পাকিস্তান ও বাংলাদেশ মিলিয়ে)।
নিরাপত্তা পেল তাদের ঘর-বাড়ী ও
ব্যবসা-বাণিজ্য। পাকিস্তানের মুসলিম
জনসংখ্যা ভারতীয় মুসলমানদের চেয়ে
কম। অথচ যত আলেম-উলামা, ডাক্তার-
বিজ্ঞানী, ইসলামের পক্ষের মোজাহিদ
পাকিস্তানে সৃষ্টি হয়েছে তার শতভাগের
একভাগও কি ভারতের মুসলমানদের মাঝে
গড়ে উঠেছে? তারা কি পেরেছে
আফগানিস্তান, কাশ্মিরের মুসলমানদের
ন্যায় মজলুম মুসলমানদের পাশে দাঁড়াতে?
তাছাড়া পাকিস্তানের মুসলমানদের
সামনে রয়েছে আল্লাহর আইনের
প্রয়োগের মহা সুযোগ। যদিও এক্ষেত্রে
সফলতা ততটা জুটেনি, তবে ভবিষ্যতে সে
সম্ভাবনা কি কম? ভারতের প্রায় ২০
কোটি মুসলমান কি আদৌ সেটি ভাবতে
পারে? তারা বড় জোর তবলিগী মডেল
নিয়ে কিছু ব্যস্ততা দেখাতে পারে।
রাষ্ট্রের নীতি শুধু অফিস আদালতে
সীমাবদ্ধ থাকে না, তা প্রভাবিত করে
দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি, আইন-আদালত,
অর্থনীতি, পোষাক-পরিচ্ছদ এমনকি
ব্যক্তির ধর্ম ও জীবন-জগত নিয়ে বিশ্বাস।
আজ যদি দেওবন্দ মাদ্রাসা বা আল-
আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের মত প্রতিষ্ঠান
বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাতে
প্রতিষ্ঠিত হয় তবে তাতে কি ইসলামের
বিজয় আসবে? বরং এতে যেটি বাড়বে
সেটি বিভক্তি। রাষ্ট্রকে দখলে নেওয়ার
জন্য জরুরী হল একটি রাজনৈতিক
অঙ্গিকার । এবং সে সাথে একতার প্রতি
গভীর আগ্রহ।
.
প্রশ্ন হল, এসব মাদ্রাসার
শিক্ষক ও ছাত্রদের তেমন কোন
রাজনৈতিক অঙ্গিকার আছে কি? আছে
কি একতার প্রতি সামান্য আগ্রহ? অথচ
ইসলামকে বিজয়ী করা তথা শরিয়তের
বিধানকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাষ্ট্রের
ক্ষমতাকে হাতে নেওয়া অপরিহার্য।
আলেমগণ সেটি না বুঝলেও শয়তানী
শক্তিগুলি সেটি বুঝে। তাই রাষ্ট্রকে
তারা ইসলামের পক্ষের শক্তির দখলদারি
থেকে দূরে রাখতে চায়। মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র ও তার সেকুলার মিত্রদের
মাঝে দেশে দেশে যে কোয়ালিশন তা
তো শরিয়তের প্রতিষ্ঠা প্রতিহত করার
লক্ষ্যেই। আর সে লক্ষটি তারা গোপনও
রাখেনি, বরং বার বার বলছে। মার্কিন
সাম্রাজ্যবাদ ও তার আঞ্চলিক মিত্ররা
শুধু ইরাক, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান,
কাশ্মির দখলে নিয়ে খুশি নয়। তারা
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মত মুসলিম
প্রধান দেশগুলোকে অধিনত রাখতে চায়।
কারণ তাদের বিচারে প্রতিটি মুসলিম
ভূমিই তালেবানদের আবাদভূমি। তাদের
অজানা নয়, ইসলামের বিজয় বা শরিয়তের
প্রতিষ্ঠা নিছক তালেবানদের এজেন্ডা
নয়। এমন এজেন্ডা প্রতিটি ঈমানদারের।
কারণ ইসলামের বিজয়ের প্রতি এ
অঙ্গিকারটুকু তো ঈমানের প্রকৃত লক্ষণ।
নইলে কাফের বা মোনাফেক থেকে তার
পার্থক্য কোথায়? এমন ঈমানদেরকেই
তারা সন্ত্রাসী বলছে। সন্ত্রাস নির্মূলের
নামে তাদের বিরুদ্ধে ভয়ানক যুদ্ধও শুরু
করেছে। আর এ যুদ্ধে মার্কিন শিবিরে
যোগ দিয়েছে বাংলাদেশের সেকুলারগণ।
দেশে তারাই এখন ক্ষমতাসীন।
আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের
সেকুলারদের ন্যায় বাংলাদেশের এ
সেকুলারপক্ষটিও তাদের হাতে ভাড়ায়
খাটতে দু’পায়ে খাড়া। পাকিস্তানে
ইসলামের বিপক্ষ সরকার নিজ দেশের
নাগরিকদের নিধনে যুদ্ধবিমান, ট্যাংক ও
দূরপাল্লার কামান নিয়ে হামলা শুরু
করেছে। নিশ্চিহ্ন করেছে গ্রামের পর
গ্রাম। ধ্বংস করছে ঘরবাড়ী, হত্যা করছে
নিরীহ গ্রামবাসীকে। নিহতদের অপরাধ,
তারা শরিয়তের প্রতিষ্ঠায় আপোষহীন।
পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর এরূপ
হত্যাযজ্ঞে প্রচন্ড খুশি মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রসহ ইসলামের তাবত বিপক্ষ
শক্তি। তবে তাদের দাবী, এ অভিযান শুধু
অব্যাহত থাকলে চলবে না, ব্যাপকতরও
করতে হবে। এই একই কাজ মার্কিনীরা
আফগানিস্তানে বিগত আট বছর ধরে
করছে। এ কাজে মার্কিনীদের বিপুল অর্থ
ও রক্তক্ষয়ও হচ্ছে। এখন অন্যরা যদি নিজ
খরচে একাজ করে দেয় তবে তাতে তাদের
প্রচন্ড খুশি হওয়ারই কথা। আর সে খুশিতেই
মার্কিন সরকার বহু শত কোটি মার্কিন
ডলার নিয়ে পাকিস্তানের সাহায্যে
এগিয়ে এসেছে।
.
সামনে দূর্দিন পাকিস্তান সরকারের এরূপ বিপুল
অর্থপ্রাপ্তি দেখে বাংলাদেশে
ইসলামের বিপক্ষ শক্তির জিহ্বাতেও যে
পানি আসবে না সেটিই কি স্বাভাবিক
নয়? ইসলামপন্থিদের নির্মূলে নামলে
রাজনৈতিক সমর্থনের পাশাপাশি যে
বিশাল অংকের মার্কিন ডলার আসে -
সেটি তারা বুঝতে পেরেছে। তাই যারা
ইসলামের বিজয় বা শরিয়তের প্রতিষ্ঠা
চায় তাদের সামনে দূর্দিন। তাদের
নির্মূলে বাংলাদেশের সেকুলার সরকার
যে কতটা আপোষহীন ও নির্মম সেটিই
মার্কিন ও ভারতীয়দের কাছে তারা
প্রমাণ করতে চাইবে। কারণ, তাদের কাছে
বাজার দর বাড়াতে এমন নিষ্ঠুরতা জরুরী।
ফলে কোরআন-হাদীসের আলোকে
ভিত্তিতে লেখা জ্বিহাদ বিষয়ক বই ঘরে
বা অফিসে রাখা শাস্তিযোগ্য অপরাধ
গণ্য হচ্ছে। বাংলাদেশের পুলিশ বহু
মানুষকে এ অপরাধে গ্রেফতারও করছে।
.
তাই শরিয়তের প্রতিষ্ঠায় যারা
নিষ্ঠাবান তাদের সামনে এবার কঠিন
পরীক্ষা। আর ঈমানের এ পরীক্ষা নিছক
নামায-রোযার মধ্য দিয়ে হয় না। পরীক্ষা
হয় অটুট ঈমান, ত্যাগ ও জানমালের
কোরবানীর মধ্য দিয়ে। পরীক্ষা হয় শত্রুর
হামলার মুখে কে কতটা ছবর করলো, কে
কতটা প্রতিরোধে যোগ দিল তার মধ্য
দিয়ে। অতীতে সংকটকালে জমিয়তে
উলামায় হিন্দ ও জামায়াতে ইসলামীর
ন্যায় ইসলামের প্রধানতম সংগঠনগুলি
সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভূল করেছে। সেটি
যেমন ১৯৪৭ সালে, তেমনি ১৯৭০য়েও।
সাতচল্লিশে এসব সংগঠনগুলি
পাকিস্তানের প্রয়োজনীয়তাটাই অনুভব
করেনি। আর ১৯৭০য়ে এসে বুঝেনি একতার
গুরুত্ব। আর এবারের সংকটে জামায়াত
নেতারা তো আনন্দে রবীন্দ্র সঙ্গীত
গাওয়া শুরু হয়েছে। অনেক মোল্লা-
মৌলভী তো রাজাকারদের বিচারের
দাবীতে রাজপথেও নেমেছে। তাদের
ধারণা, মৌলবাদ দমনের নামে বিদেশ
থেকে যে বিপুল অর্থ আসছে তা থেকে
আর দূরে থাকা কেন? ফলে যে স্লোগানে
এতকাল ইসলামের বিপক্ষ শক্তি ময়দানে
নামতো, এখন এসব মোল্লা-মৌলভীরাও
নেমেছে। ইসলামপন্থিদের মাঝে
একাত্তরে এত বিচ্যুতি ছিল না। শতবছর
আগেও ছিল না। তবে আজ যেগুলি হচ্ছে
সেগুলি নিছক বিচ্যুতি নয়। সামান্য
অপরাধও নয়। বরং আল্লাহর হুকুমের
বিরুদ্ধে প্রচন্ড বিদ্রোহ। আর এমন
বিদ্রোহ আল্লাহর আযাবকে কি আরো
তীব্রতর করবে না?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
back to top