শনিবার, ৪ জুন, ২০১৬

তাওবাঃ শয়তানের যম

কোন মন্তব্য নেই:

****তাওবাঃ শয়তানের যম****

.

এক লোক রাস্তা দিয়ে চলছেন। হঠাৎ অসাবধানতায় নর্দমায় পা টা পড়ে গেল। শরীর এবং কাপড়ে দুটোতেই বিশ্রি ও দুর্গন্ধময় নাপাকি লেগে গেল। অপর একজন সদ্য প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদন করলেন, শারঈ ইস্তেঞ্জা এখনও করেননি। তার শরীরে নাজাসাত বিদ্যমান। আরেক ব্যক্তি স্ত্রীর সাথে অন্তরঙ্গতা থেকে সদ্য মুক্ত হলেন, ফারয গোসল করা এখনও বাকি। বাহ্যিকভাবে তার দেহে নাপাকি না থাকা সত্ত্বেও তার মাঝে এক ধরনের অবস্তুগত অপবিত্রতা বিরাজ করছে।

.

তিনটি ক্ষেত্রে ঘটনাপ্রবাহ কিছুটা ভিন্ন ভিন্ন হলেও এগুলোর প্রতিটির সমাধান একই ধাচের। প্রথম ব্যক্তি যত দ্রুত সম্ভব তার গা থেকে নাপাকি সাফ করে ধুয়ে ফেলবেন, সম্ভব হলে সাবান ব্যবহার করবেন ও পূর্ন গোসল করবেন। দ্বিতীয় ব্যক্তি যত দ্রুত সম্ভব শরীয়াতের দেখানো নিয়মে পূর্ন ইস্তেঞ্জা করবেন। তৃতীয় ব্যক্তিও যত দ্রুত সম্ভব ফারয গোসল করে নিবেন। লক্ষ্য করুন, তিনটি ক্ষেত্রেই শরীয়াতের বিধানে একটা জিনিস কমন; তা হল ‘যত দ্রুত সম্ভব’ এই কাজ গুলো করার তাকীদ যেমন শরীয়াতও দেয় তেমনি ইনসানের ফিতরাতও এর অনুকূলেই সায় দেয়।

.

ধরুন কেউ কাবীরাহ করে ফেলেছেন। বড় ধরনের কোন গুনাহ, বড় নাফরমানী হয়ে গেছে। শয়তানের ধোকায় বা নফসে আম্মারার প্ররোচনায় তিনি আল্লাহর নির্ধারিত সীমাকে লংঘন করেছেন। কনক্রিট নাপাকি যেমন মানুষের শরীরে লেগে যায় তেমনি এবস্ট্রাক্ট নাপাকি তার ক্বলবে লেগে গেছে। এক্ষেত্রে শরীয়াত তার কাছে কি চায়? তার উপর হুকুম কি? সোজা হিসাব, আমরা সবাই ই জানি। তাকে খাস দিলে তওবা করতে হবে; দোষ স্বীকার করতে হবে, শরমিন্দা হতে হবে, মাফ চাইতে হবে, আর না করার সঙ্কল্প করতে হবে। তবে বাহ্যিক নাপাকিতে যেমন শরীয়াতের বিধানের পাশাপাশি ফিতরাতও সেই নাপাকি ধুয়ে ফেলে সাফ হতে বলে, এই ক্ষেত্রে ফিতরাতের অতটা প্রচন্ডতা অনুভূত হয় না।

.

কেন হয় না? কারন এই নাপাকিকে আমরা নাপাকিই মনে করি না। এই নাপাকিতে গায়ে গন্ধ হয় না, কাপড় ময়লা হয় না। তবে ক্বলবে দাগ পড়ে, দূষিত হয় এমন গোশত পিন্ড যার দ্বারা সমস্ত দেহই দূষনের শিকার হয়। এই দূষন, এই কালিমা মানুষ দেখে না তাই আমরা একে নিয়ে অত ব্যতিব্যস্ত হই না। তবে এই নাপাকি দেখেন রব্বুল আলামীন। আর এই নাপাকি তার কাছে বড্ড অপছন্দনীয়, বড্ড পূতি দুর্গন্ধময়। তিনি যেন বলতে থাকেন- বান্দা, তোকে তো আমি সাফ হবার পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিলাম; তাও বিনা পয়সায়। কেন পবিত্র হলি না?

.

দেখুন, যে জিনিস নাপাক না তা থেকে মুক্তি পাবার জন্য কত রকম ঝঞ্ঝা করি আমরা। সাদা কাপড়ে সামান্য কালি বা ঝোলের দাগ লেগেছে, আমাদের মাথা খারাপ হয়ে যায় তা তোলার জন্যে। দামী দামী ডিটারজেন্ট ব্যবহার করে দাগ না তুলে ক্ষান্ত দেই না। শরীরে ঘামের গন্ধ হয়েছে, বোতলের পর বোতল ডিওডরেন্ট আর আতর ঢেলেও শান্ত হতে পারি না। ঘরের কোথাও ধুলা জমেছে বা পাক মাটির কাদা লেগেছে, ক্লিনার দিয়ে না ধুয়ে আরাম পাই না। অথচ ক্বলবের নাপাকি এমন ভয়াবহ যে ইয়ামুল ক্বিয়ামাহতে আমার নিজের অংগ প্রত্যংগ ই সাক্ষ্য দিয়ে আমাকে সমস্ত মানব-দানবের সামনে বেইজ্জত করে ছাড়বে। আমার রব্ব সেদিন এই নাপাকির কারনে মুখ ফিরিয়ে নিবেন। আমার রাসূল সেদিন এই নাপাকির কারনে বলবেন- সরে যাও, আমি তোমার সুপারিশের ব্যাপারে অনুমতি পাই নাই।

.

গুনাহ আমাদের হবেই, এটাই আমাদের ইনসান হবার দলিল। এমনকি নবীর উম্মাত ও আল্লাহর ভালবাসার পাত্র হবার দলিলও এটাই; কারন আমাদের গুনাহ মাফের গ্যারান্টি আছে। হ্যা, যত বড় গুনাহই হোক না কেন। শরীরে নাপাকি লাগলে যেমন তা না ধুয়ে এক সেকেন্ডও শান্ত থাকতে পারি না, দ্বীনের দাবি তো ছিল গুনাহ হয়ে গেলেও তেমনি এক মুহুর্তের জন্যেও দেরি না করে সাথে সাথে তাওবায় লেগে যাওয়া। বাহ্যিক নাপাকি ধোয়ার জন্যে উত্তম উপায় যদি হয় পানি, তবে অন্তরের নাপাকি ধোয়ার জন্যে তাওবা এর চেয়েও বেশি শক্তিশালী। সাবান-পানি এগুলোর জন্যে টাকা খরচ করা লাগে, আর আমার রব্ব তো তাওবার সুযোগ বিনামূল্যে দিয়ে একে অমূল্য রতনে পরিনত করেছেন।

.

এজন্যে শরীয়াতের দাবি হল গুনাহ হয়ে গেলে অন্য কোন কিছুর আগে অতি দ্রুত তাওবা করে নেয়া, যতটা দ্রুত করা যায় তত ভাল। অপরাপর আমল তার নিজ নিজ জায়গায় থাকবে। কিন্ত গুনাহর পর তাওবাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। তাওবা করলে আল্লাহ যেমন গুনাহ গুলো মাফ করেন, তেমনি পরবর্তীতেও তাকে তাওবার তাউফিক দেন। ফলে বান্দার সাথে আল্লাহর সম্পর্ক মজবুত হয়।

.

পাশাপাশি শয়তান তাওবাকে বড্ড ঘৃনা করে। শয়তান বান্দাকে গুনাহর পর হতাশ করতে চায়। আল্লাহর সাথে তার দূরত্ব সৃষ্টি করতে চায়। এক পর্যায়ে বান্দা যখন আল্লাহর রহমতের ব্যাপারে নিরাশ হয়ে পরে তখনই শয়তান সফল। কারন এভাবে সে বান্দাকে দিয়ে আল্লাহর ওয়াদাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করাতে পারে। বান্দার সাথে আল্লাহর কৃত ওয়াদা ‘আমার রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না’ কে বান্দা তখন শয়তানের ধোকায় পরে নিজের ব্যাপারে অকার্যকর ভাবতে থাকে। অথচ আল্লাহই বলেছেন- বান্দা রাত দিন গুনাহ করে, মেঘ পর্যন্ত গুনাহর স্তর জমিয়ে ফেলে কিন্তু আমি ঠিকই করি।

.

সাইয়্যিদিনা উমার ইবনুল খাত্তাব এবং আমীরে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুম কে শয়তান এসে ফজরের সালাতের জন্যে জাগিয়ে দিত। শয়তানকে যখন উমার(রা) জিজ্ঞেস করলেন যে এটা তো তোমার কাজ না, তোমার কাজ তো ছিল আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা। শয়তান উত্তরে বলেছিল যে, আপনি যদি ফজরের জামাত ধরতে না পারেন তবে সারাদিন যে পরিমান তাওবা করবেন তার চেয়ে আমার কাছে এটাই উত্তম।

.

আল্লামা ইবনু জাওযী(রহ) কে জিজ্ঞেস করা হল, গুনাহগারের জন্য তাওবা বেশি ফলপ্রদ নাকি যিকির-আযকার। তিনি উত্তরে বললেন, একটা ময়লা জামার জন্যে সাবান বেশি দরকারী না আতর? ইমাম ইবন তায়মিয়া বলতেন- তাওহীদ যেমন সকল কল্যানের দরজা খুলে তেমনি তাওবা সকল পাপের দরজা বন্ধ করে। সালাফগন বহু নেক আমল করার পরও তাওবা জারি রাখতেন, কখনই তাওবা না করে শান্তি পেতেন না। সাইদ ইবন মুসাইয়েব, হাসান বাসরী, সুফিয়ান সাওরী, ইমাম শাফিঈ, আবু হানিফা, ইবনুল মুবারাক প্রমুখ মনীষীর তাওবার ঘটনা শুনলে রীতিমত প্রকম্পিত হতে হয়। আর সাহাবাগনের কথা বলাই বাহুল্য। এমনকি যে নবীর পূর্বের পরে সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়েছিল তিনিও প্রত্যহ সত্তর বারের অধিক তাওবা করতেন আর বলতেন- আমি কি একজন কৃতজ্ঞ বান্দা হবো না?

.

তাওবার দুয়া গুলো আমরা সর্বদা মুখস্থ রাখি। অপরাপর সকল ইবাদাতের মত তাওবার জন্যেও বিশুদ্ধ অন্তঃকরনের পাশাপাশি সুন্নাহর তরীকাও খুব জরুরী। সর্বাবস্থায় ইস্তেগফার জারি রাখি। প্রতি গুনাহর জন্যে বেশি বেশি করে ইস্তেগফার পাঠ করি। সর্বোপরি না জানা গুনাহগুলোর জন্যে সাধারন ভাবে তাওবা করি। আল্লাহর কাছে শহীদের রক্ত আর তাওবাকারীর অশ্রু খুবই মূল্যবান দুটি বস্ত। আল্লাহ আমাদের সবাইকে মাকবুল তাওবা নাসীব করেন, আমীন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
back to top